প্রায় প্রতি বছর ভয়াবহ বন্যাসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলাদেশ। এতে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ। সাইক্লোন সিডর, আইলা, মহাসেন, বুলবুল, আম্ফান, রেমাল হয়ে উঠেছিল প্রাণঘাতী। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা নিয়ে আমাদের দেশে নির্মিত হয়েছে বহু সিনেমা। এমনই কয়েকটি সিনেমার কথা তুলে ধরেছেন -আলাউদ্দীন মাজিদ
সীমানা পেরিয়ে
১৯৭০ সালে বাংলাদেশের ভয়াবহ ঝড় জলোচ্ছ্বাসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায় পরিচালক আলমগীর কবিরের সিনেমা ‘সীমানা পেরিয়ে’। বুলবুল আহমেদ ও জয়শ্রী কবিরের অনবদ্য অভিনয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে এ সিনেমাটি। এতে দেখা যায়, ভয়াবহ ঝড়ের কবলে পড়ে একটি জাহাজ। ঝড় থেমে যাওয়ার পর সেই জাহাজের দুই যাত্রী, এক তরুণ ও তরুণী ভাসতে ভাসতে একটি অজানা দ্বীপে এসে পৌঁছায়। একসময় তারা বুঝতে পারেন এ দ্বীপে তারা দুজন ছাড়া আর কোনো জনমানব নেই। তারপর শুরু হয় দুজনের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
সারেং বৌ
শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭৮ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মাণ করেন সিনেমা ‘সারেং বৌ। এতে উঠে আসে জলোচ্ছ্বাসে বিপর্যস্ত উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কষ্টের এক ব্যতিক্রমী গল্প। সিনেমায় দেখা যায়, হঠাৎ এক দিন তীব্র বাতাসে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ ধরেই নিল এ যেন জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস। শুরু হলো উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। জলোচ্ছ্বাসের পর চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। মানুষ, পশুপাখি কেউই রক্ষা পায়নি ঝড়ের কবল থেকে। বেঁচে থাকা যুবক কদম পানি পানি করে কাতরাচ্ছে। পান করার মতো একফোঁটা পানি কোথাও নেই। তারপর আসে ‘সারেং বৌ’ ছবির সেই কালজয়ী দৃশ্য। চরে মিঠাপানি না পেয়ে নিজের স্তনদুগ্ধ দিয়ে স্বামী সারেং কদমের প্রাণ বাঁচায় স্ত্রী। এতে মুখ্য দুই চরিত্র কদম সারেং ও নবীতুনের ভূমিকায় অভিনয় করেন যথাক্রমে ফারুক ও কবরী।
কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া
২০২২ সালে মুক্তি পায় ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ সিনেমাটি। এতে ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবিকার সংকট এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার কাহিনি চিত্রায়িত হয়েছে। এটি রচনা ও পরিচালনা করেছেন মুহাম্মদ কাইয়ুম। অভিনয়ে জয়িতা মহলানবিশ, উজ্জ্বল কবির হিমু, সুমি ইসলাম, সামিয়া আকতার বৃষ্টি, বাদল শহীদ, মাহমুদ আলম ও আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ।
সাঁতাও
খন্দকার সুমন পরিচালিত ‘সাঁতাও’ সিনেমায় উঠে এসেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সাত দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হওয়ার সময়টাকে বোঝাতে দেশের উত্তরাঞ্চলে ‘সাঁতাও’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ২০২৩ সালে সিনেমাটি মুক্তি পায়। এতে অভিনয় করেছেন আইনুন পুতুল, ফজলুল হক, শ্রাবণী দাস রিমি প্রমুখ।
দুখাই
প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম। ‘দুখাই’ নামের এ সিনেমায় ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে দুখাই তার পরিবারের সবাইকে হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এরপরও তার জীবন থেমে থাকে না। সে আবারও নতুন জীবন শুরু করে। একটি ফুটফুটে মেয়ের জন্ম হয়। দুখাই তার মেয়ের নাম রাখে সুখাই। দুখাই যেমন আজীবন দুঃখ পেয়ে গেছে, সুখাই যেন আজীবন সুখ পায়, এটুকুই চাওয়া তার। কিন্তু দুখাইয়ের দুঃখগাথা যেন শেষ হয় না। আবারও ঝড় এসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেয়, কেড়ে নেয় তার সুখাইকে। সিনেমাটি ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায়। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর শতাব্দীর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় দশ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। এই মর্মান্তিক কাহিনি নিয়ে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেন সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, রোকেয়া প্রাচী প্রমুখ।
নোনাজলের কাব্য
২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন প্রান্তিক জেলেপল্লির জীবন চিত্রায়িত হয়েছে ‘নোনাজলের কাব্য’ চলচ্চিত্রে। এতে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জেলেদের দৈনন্দিন জীবন-সংগ্রাম, প্রতিকূল আবহাওয়ায় টিকে থাকার লড়াই, জেলে সমাজের রীতিনীতি স্থান পেয়েছে।
যেখানে ঘূর্ণিঝড় দানা বেঁধে থাকার পরও দরিদ্র জেলেদের বিপদসংকুল সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে হয় প্রভাবশালীদের চাপে। ছবিটি পরিচালনা করেছেন রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত। অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু, তিতাস জিয়া, তাসনুভা তামান্না, শতাব্দী ওয়াদুদ প্রমুখ।