সময়টা ১৯৯৬ সাল। ঢাকা শহর তখনো এতটা বিক্ষুব্ধ, ভিড়ভাট্টার নয়। সাভার পার হয়ে আশুলিয়ায় পৌঁছানো মানেই এক অন্য জগৎ-নিখাদ গ্রাম, কাঁচা রাস্তা, পাশে নদী, মাঠে ধান আর দূরে দেখা যায় মহিষের গাড়ি। সেখানে ছিল একটা বড় বট গাছ। যার তলায় প্রতি সপ্তাহে বসত ছোটখাটো হাট। আর ঠিক সেই জায়গাতেই হয়েছিল বাংলাদেশের সংগীত ইতিহাসের এক মজার, স্মরণীয় ফটোসেশন- যেখানে ছিলেন গুরু জেমস, অভিনেত্রী তানিয়া আহমেদ আর ‘নতুন কুঁড়ি’ থেকে উঠে আসা তরুণ তারকা ঈশিতা।
বটতলায় তিন তারকা
সেই নদীর ধারের বট গাছের তলায় আনন্দভুবন ঈদ সংখ্যার ফটোসেশনের আয়োজন। তিন তারকা জেমস, তানিয়া আহমেদ আর ঈশিতা; চার পাশে ফটোগ্রাফার, রিফ্লেক্টর, আলো, মেকআপ- শুরু হলো প্রস্তুতি।
মহিষের গাড়ি ও দৌড়ের গল্প
সবাই প্রস্তুত। হাতে ক্যামেরা, রিফ্লেক্টর, পোশাক ঠিক করা- এমন সময় হঠাৎ দেখা গেল নদীর ধারে এক মহিষের গাড়ি যাচ্ছে গাছের বোঝা নিয়ে। চটজলদি প্রস্তাব এলো, ‘গাড়িটিতেই যদি তিন তারকাকে তোলা যায়!’ গাড়োয়ানও রাজি, মাটির ঘ্রাণ মেশানো গ্রামীণ সৌন্দর্য আর তারকাদের আধুনিক আবেদন মিলিয়ে এক অন্যরকম দৃশ্যের প্রস্তুতি শুরু হলো। বটতলায় প্রস্তুত হলো ক্যামেরা, সাজসজ্জা, আর তিনজন তারকা- সব মিলিয়ে অপূর্ব পরিবেশ। কিন্তু হঠাৎই ঘটল বিপত্তি! রুপালি আলোয় হঠাৎ বেচারা মহিষ গেল ঘাবড়ে, দিল দৌড়! ঈশিতা ছিটকে পড়লেন, তানিয়া আপা লাফ দিতে গিয়ে গোড়ালি মচকালেন। কিন্তু গুরু জেমস? তিনি তখনো গিটারিস্টের মতো স্থির, হাত দিয়ে গাড়োয়ানকে আঁকড়ে ধরে বসে আছেন যেন পুরো ঘটনা তার নিয়ন্ত্রণে! ক্যামেরার চোখ সেই মুহূর্তটা ধরেছিল- একদিকে ভয়, অন্যদিকে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ। অবশেষে মহিষ থামল। ফটোশুট বেঁচে গেল, আর সেই মুহূর্ত ধরা পড়ল ক্যামেরায়।
প্রচ্ছদে প্রথম গুরু
পরের বছর ঈদ সংখ্যায় ছাপা হলো সেই ছবিগুলো, যা হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের সংগীত-সংস্কৃতির এক কিংবদন্তি প্রচ্ছদ। প্রথমবারের মতো কোনো পত্রিকার প্রচ্ছদে এককভাবে এলেন গুরু জেমস। প্রচ্ছদে থাকা চারটি ছবির প্রথম দুটি ছিল আশুলিয়ার, আর বাকি দুটো শ্রীপুরের। কিন্তু আলোচনার কেন্দ্রে ছিল মহিষের গাড়ির সেই সেশন- যা আজও অনেকের কাছে ইতিহাসের রোমাঞ্চকর কাহিনি।
ফটোসেশনের স্মৃতি রোমন্থনে
এই তিন তারকার ফটো ও স্মৃতি শেয়ার করেছেন ওবায়দুল ফাত্তাহ তানভীর, যা নজরুল সৈয়দের লেখায় উঠে এসেছে। তার ভাষ্যে, ‘এই ফটোসেশন শুধু ছবি নয়, একরাশ গল্প, হাসি আর স্মৃতির ভাণ্ডার। তখনকার আনন্দভুবন মানেই তরুণদের রঙিন পৃথিবী। আজও ভাবলে অবাক লাগে, যে আশুলিয়া এখন শপিংমল আর ফ্লাইওভারে ঘেরা, একসময় সেখানে জেমস, তানিয়া, ঈশিতাকে দেখা গিয়েছিল মহিষের গাড়িতে! সময়ের সেই দৌড়ে যেমন গ্রাম বদলেছে, তেমনি বদলেছে আমাদের স্মৃতির ফ্রেমও। কিন্তু গুরু জেমসের সেই দৃশ্য-রোদ, নদী, বটতলা আর মহিষের গাড়ি- আজও বাংলাদেশের পপসংগীত ইতিহাসের এক মজার, নস্টালজিক অধ্যায়। তারকা মডেল ও অভিনেত্রী এই ফটোসেশনের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ‘আহা! অসাধারণ সেই স্মৃতি। মহিষের গাড়িতে ওঠার দুই মিনিটের মধ্যেই মহিষ দিল দৌড়, আর আমি ছিটকে পড়ে গেলাম।’