যত দ্রুত আলোচনায় এসেছিল, ঠিক তত দ্রুতই আলোচনার বাইরে চলে গেল ‘অগ্নি’। বিশাল বাজেট, সেরা প্রযুক্তি আর গল্পের ছবি এমন গালগল্পে ভরা আওয়াজ তুলে ‘অগ্নি’ মুক্তি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি এর প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়া। এখন দাবি করছে মুক্তির এক সপ্তাহে আয় করেছে চার কোটি টাকারও বেশি। যা নাকি এ দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই প্রথম। মুক্তির পর প্রথমে তাদের বক্তব্য ছিল প্রথম দিনের আয় এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু প্রদর্শক সমিতি, বুকিং এজেন্ট, প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের কথায় পাওয়া গেছে বিপরীত চিত্র। তাদের কথায় মাত্র দুইশ’ হলে মুক্তি দিয়ে এত অল্প সময়ে এত অর্থ কালেকশন কিভাবে সম্ভব!
১৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় ছবিটি। মুক্তির দিন সাপ্তাহিক ছুটি ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস থাকায় দর্শকরাও হুমড়ি খেয়ে পড়েন প্রেক্ষাগৃহে। শনিবারও থাকে একই চিত্র। কিন্তু চলচ্চিত্র ব্যবসার সাফল্যের হিসাব শুরু হয় রবিবার থেকে। অগ্নি মুক্তির দিন ঢাকার প্রেক্ষাগৃহগুলোতে দর্শকের ভিড় থাকলেও মফস্বলের চিত্র ছিল বিপরীত। ঢাকার ওপেনিং কালেকশন ৮০ শতাংশ হলেও বাইরে এর পরিমাণ ৫০ শতাংশের বেশি নয়। মানে গড় কালেকশন ৬৫ শতাংশের ঘর পেরুতে পারেনি। এর পরের কালেকশনের হার আরও কম। ফলে জাজের দাবি ছিল অযৌক্তিক। কারণ প্রদর্শক সমিতির মতে গড় কালেকশন ৭০ শতাংশ না হলে কোনো চলচ্চিত্রকে হিট বলে গণ্য করা যায় না।
হল মালিকরা জানান, ছবিটি মুক্তির আট দিনের মাথায় এসে দর্শক কমে যায়। তারা মনে করেন, ভালো লোকেশন, ডিজিটাল সাউন্ড ও আধুনিক ফাইটের কারণে প্রথম দিকে ছবিটি দর্শক দেখতে এসেছে। কিন্তু দুর্বল গল্প, ত্রুটিযুক্ত পরিচালনা ও আরেফিন শুভ-মাহির কাঁচা অভিনয়ের কারণে ছবিটি থেকে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। একটি ছবি ব্যবসা পেতে হলে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ সপ্তাহ হাউসফুল থাকতে হবে। এরপর বলা যাবে ছবিটি ব্যবসা সফল হয়েছে। অথচ জাজ মাল্টিমিডিয়া ছবিটির এক সপ্তাহের ব্যবসায়িক সাফল্যকে ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে এমন মন্তব্যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, এশিয়া মহাদেশে নারী ও ইতিহাস প্রধান চলচ্চিত্রের সাফল্যের নজির খুবই কম। অগ্নি হচ্ছে নারীপ্রধান চলচ্চিত্র। এতে অভিনয় করেছেন আনকোড়া নায়িকা মাহি। ২০১১ সালে জাজ থেকেই তার প্রথম ছবি মুক্তি পায়। এ পর্যন্ত মাহি অভিনীত যে কটি ছবি মুক্তি পেয়েছে তার প্রায় সবই জাজের এবং রোমান্টিক ঘরানার। ফলে তাকে হঠাত্ করে অ্যাকশন লেডি হিসেবে পর্দায় তুলে ধরে দর্শক গ্রহণযোগ্যতা লাভে ব্যর্থ হয়েছে নির্মাতা। আনকোড়া অভিনয় শিল্পী হওয়ার কারণে মারকুটে চরিত্রে সাবলীলভাবে অভিনয় করতে পারেননি মাহি। এ ছাড়া চিত্রনাট্যে গতি ছিল না। নির্মাণেও ছিল ত্রুটি। গল্পের বুনন ছিল দুর্বল। যেমন ছবির একটি দৃশ্যে প্রায় দশতলা ভবন থেকে লাফিয়ে নামার সময় অন্য ভবনের জানালায় থাকা ভিলেনকে নিখুঁত গুলি করে নায়িকা। এর পরও দু’পায়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকে মাটিতে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের চিত্রায়ণ দর্শকদের মুখে মুচকি হাসি ফোটাতে বাধ্য করে। আবার আরেকটি দৃশ্যে মাঝ সমুদ্রে শুধু একটি বোট দেখানো হয়। অথচ ভিলেন গিয়েছে স্পিডবোটে। আর মূল চরিত্র তানিশা সাঁতার কেটে সেখানে পৌঁছায়। এরপরের দৃশ্যটা অনেকটাই খাপছাড়া। এতটা পথ সাঁতার কেটে বোটে ওঠার পরও তানিশার চুল বাতাসে উড়তে থাকে। অথচ এখানে দেখানোর প্রয়োজন ছিল চুল পুরোপুরি ভেজা। এরকম বেশ কিছু দৃশ্য রয়েছে যা সমালোচকদের অতি উত্সাহী করে তুলবে।
অন্যদিকে, ছবিটির গল্প হলিউডের ছবি ‘কলম্বিয়ানা’ থেকে ধার করা। সেই ছবির সঙ্গে অগ্নির বিভেদ শুধু নায়ক আরেফিন শুভর চরিত্রটি। এ ছাড়া গোটা চিত্রায়ণই ‘কলম্বিয়ানা’র অনুকরণ। চলচ্চিত্রকারদের মতে, এমনিতেই পরিচালক ইফতেখার চৌধুরী তার চলচ্চিত্র মুক্তির আগে দর্শকদের আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখান। যা করেছিলেন তার প্রথম ছবি ‘খোঁজ দ্য সার্চ’-এর ক্ষেত্রে। মুক্তির পর ‘সার্চ’ মুখথুবড়ে পড়েছিল। এরপর ‘দেহরক্ষী’ এবং সবশেষে ‘অগ্নি’ও একই ভাগ্যবরণ করল।
সবশেষে বলতে গেলে, ব্যয়বহুল একটি ছবিতে চিত্রনাট্য অনুসরণ করা অনর্থক। আমাদের দেশে অনেক ভালো কাহিনী রয়েছে। পুরনো কোকাকোলা বোতলের মোড়ক বদলিয়ে অন্য পানীয় দেওয়া যেতে পারে তবে বোতল কিন্তু কোকাকোলাই থাকবে!
আরেকটা কথা না বললেই নয়, তা হলো কোনো কিছুই বাড়িয়ে বলা ঠিক নয়। অগ্নি অবশ্যই ব্যবসা সফল ছবি। কিন্তু ছবির ভাষায় বা ব্যবসায়িক মাপকাঠিতে একে আকাশচুম্বি সফলতা বলা চলে না। কারণটা আগেই বলা হয়েছে— একটি ছবি ব্যবসা পেতে হলে কমপক্ষে ছয় থেকে সাত সপ্তাহ হাউসফুল থাকতে হবে। এরপর বলা যাবে ছবিটি ব্যবসা সফল হয়েছে।