অশ্লীলতা ও পাইরেসির পর দেশীয় চলচ্চিত্রে নতুন অবক্ষয় শুরু হলো। আর তা হচ্ছে ডিজিটাল প্রতারণা। মানে ডিজিটাল ছবির নামে স্বল্প খরচে টেলিফিল্ম বানিয়ে তা দেখাতে গিয়ে দর্শকের মনে বিরক্তির উৎপাদন করা হচ্ছে। এ কারণে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত সিংহভাগ ডিজিটাল ছবিই ফ্লপের তালিকায় নাম লেখিয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে ৪৯টি চলচ্চিত্র। এগুলোর মধ্যে হিট হয়েছে মাত্র পাঁচটি। এগুলো হচ্ছে- অগি্ন, আমি শুধু চেয়েছি তোমায়, হিরো দ্য সুপারস্টার, মোস্ট ওয়েলকাম টু এবং হানিমুন। আর ডিজিটাল প্রতারণার কবলে পড়ে সুপার ফ্লপ হয়েছে ২৪টি চলচ্চিত্র। এগুলো হচ্ছে- দাগ, কি দারুণ দেখতে, মনের মধ্যে লেখা, তোমার কাছে ঋণী, প্রেম কি অপরাধ, কুসুমপুরের গল্প, সীমারেখা, অনন্তকালের..., অনুক্রোশ, দবির সাহেবের সংসার, এক নাম্বার আসামী, মায়ের মমতা, জান, ফাঁদ, দুটি মনের পাগলামী, প্রিয়া তুমি সুখী হও, কখনও ভুলে যেওনা, আগে যদি জানতাম তুই হবি পর, লাভ স্টেশন, তুই শুধু আমার, ভালোবাসার তাজমহল, ভালোবাসতে মন লাগে, ক্ষোভ এবং সেদিন বৃষ্টি ছিলো।
সিনিয়র চলচ্চিত্রকারদের মতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে চলচ্চিত্র নির্মাণে নেগেটিভের প্রয়োজন হয় না। তাই এ ক্ষেত্রে বিশাল অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় হয়। আর এ বিষয়টি প্রযোজকের কাছে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে পরিচালক তাকে চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রলুব্ধ করে। কিন্তু ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণে পোস্ট প্রোডাকশন এবং সাউন্ড সিস্টেমের কাজ প্রধান। এবং এ ক্ষেত্রে ব্যয় বেশি। বিষয়টি গোপন করায় না বুঝে চলচ্চিত্র নির্মাণে এসে ক্ষতির মুখে পড়েন প্রযোজক। তা ছাড়া ছবি প্রদর্শনের সময় ডিজিটাল মেশিন ভাড়া করার বিষয়টিও জানানো হয় না প্রযোজককে। তা ছাড়া স্বল্প খরচ দেখাতে গিয়ে আনকোড়া নামসর্বস্ব অপরিচিত মুখ দিয়ে অভিনয় করাতে গিয়ে টেলিফিল্ম মার্কা চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। ছবির প্রিন্ট এবং সাউন্ড খারাপ থাকে। এসব চলচ্চিত্র চালাতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়েন প্রযোজক ও প্রেক্ষাগৃহ মালিক। দর্শকের অভাবে এমন বেশির ভাগ ছবিই দুএকদিনের মধ্যে প্রেক্ষাগৃহ থেকে নামিয়ে ফেলতে হয়। এসব ছবি দেখতে এসে উত্তেজিত দর্শক প্রেক্ষাগৃহ ভেঙেছে। মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, কিছু অসাধু লোক টেলিফিল্ম বানিয়ে তা ছবি হিসেবে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এতে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে সিনেমা হল মালিকরা। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে 'ভালোবাসার বন্ধন' নামে এ জাতীয় একটি ছবি দেখতে গিয়ে বিক্ষুব্ধ দর্শক রাজধানীর একটি প্রেক্ষাগৃহে ভাঙচুর চালায়।
সেন্সর বোর্ডের সদস্য নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, বোর্ডে কেউ চলচ্চিত্র নামে জমা দিলে তা চলচ্চিত্র হিসেবেই ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুযায়ী তাকে চলচ্চিত্রের সেন্সর ছাড়পত্রই দিতে হয়। তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে অনেকে এখন কম খরচের সুযোগে টেলিফিল্মের আদলে চলচ্চিত্র বানাচ্ছে। এ ধরনের দৈন্যতা আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য ক্ষতিকারক। এটি পরিহার করতে হবে।
চাষী নজরুল ইসলাম বলেন, ৩৫ মিলিমিটারে শুট করা পরিহার করতে গিয়ে এই বিপত্তি ঘটেছে। বিশ্বের সব জায়গায় এখনো ৩৫ মিলিমিটারে শুট করে পরে তা ডিজিটালে ট্রান্সফার করা হয়। আমার মনে হয়, ৩৫ এমএম-এ আবার শুট শুরু হলে চলচ্চিত্রের নামে টেলিফিল্ম নির্মাণ বন্ধ হবে।
চলচ্চিত্রকার ছটকু আহমেদ বলেন, প্রকৃতপক্ষে স্টক ছাড়া অন্য খরচ একই। শুধু ডিজিটাল ক্যামেরার কারণে প্রযোজক বিপুল অর্থের স্টক ক্রয় থেকে বেঁচে যায়। সম্পাদনার ক্ষেত্রেও সমস্যা কমে। তবে অন্য সব খরচ ঠিকই থাকে।
শাকিব খান বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছবি প্রযোজনা করব আবার মেশিন ভাড়া করে তা প্রদর্শন করব এটি হতে পারে না। এটিও ডিজিটাল চলচ্চিত্র ব্যবসায় বড় বাধা।
এম এ জলিল অনন্ত বলেন, এখনকার অনেক নির্মাতা ডিজিটালের অর্থই বোঝে না। অন্য সব বিষয় বাদ দিলেও পোস্ট প্রোডাকশন এবং সাউন্ড সিস্টেম ছাড়া ডিজিটাল চলচ্চিত্র হয় কিভাবে। এসব তো ব্যয়বহুল।
স্বপন আহমেদ বলেন, সত্যিকারের ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণ ব্যয় ৩৫ মিলিমিটারে নির্মিত চলচ্চিত্রের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ এই পদ্ধতির নামে জোড়াতালি দিয়ে টেলিফিল্ম বানিয়ে দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রতি দর্শকের আস্থা নষ্ট করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ঢালিউড শিল্প কঠিন হুমকির মুখে পড়বে।