শুটিং করতে গত ২০ এপ্রিল নেপাল গিয়েছিলেন অভিনয়শিল্পী শাহরিয়ার নাজিম জয়, রুনা খান, শাহাদাত হোসেন এবং কল্যাণ। সেখানে গিয়ে ভূমিকম্পের কবলে পড়েন তারা। ভয়াবহ ভূমিকম্পে চোখের সামনে দেখে এসেছেন ধ্বংসযজ্ঞ। ফিরে এসেছেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে। নেপাল থেকে ফিরেছেন সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো চোখ বুজলেই সেই ভয়াবহ দিনগুলো ভেসে ওঠে। অস্থিরতা জাগে মনে।
রুনা খান বলেন, 'ভয়াবহ দিনগুলো ভোলা যাচ্ছে না।' তিনি বলেন, 'ভূমিকম্পের আগ মুহূর্তে পাহাড়ের ওপর নাগরকোট ক্লাব হিমালয় রিসোর্টের সামনে আমাদের শুটিং চলছিল। যদিও আমি তখন ফ্রেশ হতে গিয়েছিলাম। ভূমিকম্প শুরু হলে ফ্রেশ রুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে রিসোর্টের সামনের খোলা মাঠে আশ্রয় নিই। এ সময় পাহাড়ের ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ছিল। যার ফলে পাহাড়ি রাস্তা, রিসোর্ট, বাড়িঘর সবকিছু ধুলায় মিশে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে ইউনিটের সবাই পাহাড় থেকে নিচে নামার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু উঁচু-নিচু পাহাড় বেয়ে নামতে গিয়ে আমি পড়ে যাই। ফলে শরীরের বিভিন্ন স্থানে কেটে ছিলে যায়। আর পা মচকে যায়। তখন কল্যাণ আর জয় ভাই আমাকে কোনোভাবে নিচে নামিয়ে আনেন।' তিনি আরও বলেন, 'চোখের সামনে মৃত্যু দেখে এসেছি। বার বার দেশের কথা মনে পড়ছিল। আমার মেয়ে রাজেশ্বরীর মুখ ভেসে উঠছিল।'
শাহরিয়ার নাজিম জয় বলেন, 'ভূমিকম্প থেমে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পর আমরা কাঠমান্ডুর উদ্দেশে রওনা দিই। কিন্তু ভাঙা রাস্তা আর বিধ্বস্ত বাড়িঘরের কারণে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে রাত ১২টায় কাঠমান্ডুতে এসে পৌঁছাই। যদিও এটা মাত্র দেড় ঘণ্টার রাস্তা ছিল। পৌঁছেই রুনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই কোনো চিকিৎসা না নিয়ে হোটেলের উদ্দেশে রওনা দিই। কিন্তু আমরা যে হোটেলে উঠেছিলাম সেখানেও ফাটল ধরেছে। ফলে আমরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ি।' জয় আরও বলেন, 'ভূমিকম্পের পর আমরা দেশে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। মোবাইলের নেটওয়ার্ক কাজ করছিল না। তবে যখন যোগাযোগ সম্ভব হয়, তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। কারণ পরিবারের সবাই কতটা চিন্তা করছে তা জানতাম। যখন যোগাযোগ সম্ভব হয়, তখন একটু নিশ্চিন্ত হই। তখন মনে শুধু একটিই ভাবনা, কখন দেশে ফিরব'।
শাহাদাত জানান, 'আমরা আশ্রয়হীন হয়ে থাকার খবর পেয়ে নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি গাড়ি হোটেল থেকে আমাদের নিয়ে যায়। ২৫ এপ্রিল সারা রাতই দূতাবাসের কম্পাউন্ডে ছিলাম। সে কি শীত। ভয়ানক ঠাণ্ডা। কিন্তু চিন্তায় সে ঠাণ্ডা ঠিক গায়ে লাগছিল না। আমাদের মতো অনেক বাংলাদেশি সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। খুব একটা সমস্যা না হলেও মানসিকভাবে ভীত হয়ে পড়েছিলাম সবাই। খুব কাছ থেকে মৃত্যু দেখে এসেছি। সবার দোয়ায় ফিরে এসেছি'।
সবার মতো কল্যাণের মনের অবস্থাও একই। তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না সেই স্মৃতি। কল্যাণ জানান, 'মাথাটা ব্লক হয়ে আছে। থমথমে লাগছে সবকিছু। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলেও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছি।' তিনি বলেন, 'আমরা শুটিং করছিলাম পাহাড়ের ওপর। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। জয় ভাই একটু অসুস্থ ছিলেন। আর রুনা আপা তখন ছিলেন ওয়াশরুমে। ভূমিকম্পের সময় সেই ওয়াশরুম রুনা আপার চোখের সামনেই ভেঙে পড়ে। আর জয় ভাই যে উঁচু টিলার ওপর ছিল সেই টিলাটি দেবে গিয়েছিল। জয় ভাই এমন দৌড় দিয়েছিল, সে নিজেও জানে না কোথায় দৌড়ে সে আশ্রয় নিয়েছে। চোখের সামনে দেখতে থাকি বিল্ডিং ধসে পড়েছে। রিসোর্ট, গার্ডেন, লোহার বড় বড় গেটগুলো একটু একটু পর ভেঙে পড়ছে। আমরা উপায় না পেয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় যাই। যাওয়ার একটু পর দেখি আমরা যেখানে শুটিং করছিলাম সেই পাহাড় ভেঙে পড়ল। একটু পরপর তখনো ভূমিকম্প চলছিল। সব জায়গায় খাড়া পাহাড়। কোথায় আমরা থাকব সেটা খুঁজে বের করতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর কিছু পর্যটকসহ আমরা সাত-আটটা গাড়ি খুঁজে পাই। তখন মনে হলো যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমরা মনে হয় দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছি। শহরের প্রায় সবকিছুই ছিল বিধ্বস্ত। কিছু খাব যে তারও কোনো ব্যবস্থা নেই। সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ। হোটেলে খাবারের কোনো অর্ডার নিচ্ছিল না।'
এরপরের ঘটনা জীবনযুদ্ধ জয়ের। অ্যাম্বাসির সহায়তায় বিমানে চড়ে দেশে ফিরেছেন সবাই। কিন্তু কেউই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছেন না। সবার কাছেই দেশে ফেরা এবং বেঁচে থাকাটা যেন দ্বিতীয় জীবন প্রাপ্তির বেদনাময় আনন্দ।