নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে ধস নামা চলচ্চিত্র শিল্পে মাঝে মধ্যে কিছুটা আশার আলো দেখা দেয়। উৎসাহে বুক বেঁধে নবীন-প্রবীণ নির্মাতারা নির্মাণে আসেন। প্রেক্ষাগৃহ মালিকরাও বন্ধ প্রেক্ষাগৃহ চালু করতে শুরু করেন। পরক্ষণেই আবার হতাশা দেখা দেয়। খরার কবলে পড়ে চলচ্চিত্র। কিন্তু কেন? চলচ্চিত্রকাররা উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, এর কারণ অনেক।
নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণের পূর্বশর্ত হচ্ছে উন্নত চিত্রনাট্য এবং অভিনয়শিল্পী। যার অভাব এখন প্রকট। সিনিয়র চিত্রনাট্যকারদের বেশির ভাগই বেঁচে নেই। তা ছাড়া নির্মাতাদের নকল প্রবণতা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে। সীমিত বাজেট দিয়ে বলিউড বা তামিল ছবির নকল করাও যে সম্ভব নয় তাও তারা বোঝে না। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে, শুধু আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে দর্শকদের আকৃষ্ট করা যাবে না, প্রয়োজন সত্যিকারের বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ।
সুচন্দা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা হচ্ছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ছবি বানাচ্ছে। এখন চাকরির মতো করে ছেলেমেয়েরা চলচ্চিত্র নির্মাণে তাদের ক্যারিয়ার গড়ছে। এটা অবশ্যই সুখবর। বিশ্বায়নের যুগে তারা চিন্তা-ভাবনাকেও ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের গণ্ডির বাইরে। টেলিভিশনের নাটকে যারা কাজ করছেন তাদের অনেকে চলচ্চিত্রে আসছেন এবং ভালো করছেন। সরকার এখন প্রতিবছর ছয়টি ছবিকে অনুদান দিচ্ছে। নতুন নির্মাতাদের জন্য অবশ্যই এটা একটা সুযোগ। এফডিসির আধুনিকায়ন হচ্ছে। এসব সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে চলচ্চিত্রে অবশ্যই পরিবর্তন আসবে।
আমজাদ হোসেন বলেন, ভালো গল্প আর অভিনয়শিল্পীর অভাব এখন প্রকট। সঙ্গে রয়েছে নকল ছবির ছড়াছড়ি। ঘরে বসে এখন সহজেই বিদেশের ছবি দেখা যায়। বলতে গেলে এমন অনেক কারণেই আবার আমাদের চলচ্চিত্র গতি হারিয়েছে।
আজিজুর রহমান বলেন, শুধু প্রযুক্তিগত গ্লামার দিয়ে তো দর্শকমন জয় করা যাবে না। গল্প ও অভিনয়ে জোর থাকতে হবে। যা এখন নেই। এখনকার গল্প এবং শিল্পীর মধ্যে গভীরতা নেই। নির্মাতাদের মধ্যেও জ্ঞান ও গুণের অভাব রয়েছে। বোম্বে এবং তামিল ছবির নকল করতে অনেকে ব্যস্ত। কিন্তু আমাদের স্বল্প বাজেট দিয়ে তো তাদের ছবি নকলও সম্ভব নয়। দর্শক স্যাটেলাইট চ্যানেলে আসল ছবি দেখে এর তারতম্য সহজেই বুঝতে পারছে। তাই দর্শকদের বোকা ভাবা বা ধোঁকা দেওয়ার সুযোগ নেই। বুঝতে হবে আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ভিন্ন। ছবি হবে বিনোদনের জন্য।
হাফিজউদ্দিন বলেন, সিনেমা হলগুলোর পরিবেশ ভালো নেই। ঢাকার বাইরের অনেক সিনেমা হলই গোডাউন ঘরের মতো। পরিবেশ না থাকায় দর্শক সেখানে যাচ্ছে না। অনেক হল মালিক হল ভেঙে তৈরি করছেন মার্কেট। সেখানে থাকছে না সিনে কমপ্লেক্স। নেই ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম, উন্নত প্রজেকশন সুবিধা এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। এসব কারণেই হলগুলো দর্শক টানতে পারছে না বলে দাবি করছেন অনেকেই।
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড বলেন, ঘুরে ফিরে একই ফর্মুলা। প্রেম, দ্বন্দ্ব, অ্যাকশন, মিলন। একই গল্পের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে চলচ্চিত্র। শিল্পী সংকট তো আছেই। ঘুরে ফিরে একই মুখ। ভালো নির্মাতা ও গল্পের অভাব। হিন্দি ও তামিল ছবির নকল চলছে দেদারসে। ফলে চলচ্চিত্রের মান নিম্নগামী হচ্ছে। ভিডিও পাইরেসি তো রয়েছেই। মেধাস্বত্ব আইন সেই ব্রিটিশ আমলের। ফলে পাইরেসি বন্ধ করা যাচ্ছে না। নতুন অভিনেতা অভিনেত্রী তৈরির দায়িত্ব নির্মাতার। তারা দায়িত্ব এড়িয়ে ব্যবসার মুনাফা তুলতে ব্যস্ত। এক সময় তারকা আনা হতো মঞ্চ থেকে। বর্তমানে চলচ্চিত্রে উপেক্ষিত মঞ্চের তারকারা।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ক'বছর আগেও আমাদের চলচ্চিত্রে যে দুরবস্থা ছিল এখন তা কাটিয়ে ওঠা গেছে। নতুন প্রযোজনা সংস্থা, নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পী আসছে এবং তারা ভালো করছে। তাদের সময় দিতে হবে। রাতারাতি সব বদলে ফেলা সম্ভব নয়। ষাট-সত্তর বা আশির দশক থেকে এখন বিনোদনের মাধ্যম অনেক বেড়েছে। তাই পলিসি মেকারদের প্রয়োজন কীভাবে চলচ্চিত্রে পূর্ণমাত্রায় প্রাণসঞ্চার করা যায় সেই চিন্তা করা। প্রেক্ষাগৃহের উন্নয়ন ও চলচ্চিত্র নির্মাণসহ সব ক্ষেত্রে সরকার যদি ব্যাংক লোন দেয় তাহলে নিঃসন্দেহে অবস্থার উন্নয়ন হবে। তবে নিজ দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি লক্ষ্য রেখে জীবনের গল্প বলতে হবে। মানে নকল নয়, আমাদের ঢঙে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। মোস্তফা কামাল রাজ বলেন, এখনকার নির্মাতাদের মধ্যে নকল প্রবণতা জেঁকে বসেছে। আগে ধ্যানধারণা ছিল শিল্পমুখী। আর এখনকার দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বাণিজ্যিক। ফলে দর্শক বড়পর্দায় জীবনের প্রতিচ্ছবি আর স্বপ্নের বাস্তবায়ন না পেয়ে হতাশ হচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু এক বা দুই মাসের মধ্যে যেনতেনভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে এর মান নষ্ট হচ্ছে। এভাবে দর্শকদের বোকা বানাতে গিয়ে চলচ্চিত্রকাররা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থার উন্নতি তখনই ঘটবে যখন আমরা দর্শকদের এমন জিনিস দেব যা তারা আগে পায়নি। তা ছাড়া সেন্সর বোর্ডের উদার এবং সুস্থ নির্মাণের প্রতি নির্মাতাদের দায়িত্ববান হতে হবে।