দেশের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমামের ৮০তম জন্মদিন আজ। ১৯৩৫ সালের ২৭ জুলাই ভারতের বর্ধমানে জন্ম নেন বহু গুণে গুণান্বিত এ ব্যক্তিটি। চার বছরের আলী ইমাম আর দুই বছরের হাসান ইমামকে নিয়ে মাত্র ২০ বছর বয়সে মা সৈয়দা সাঈদা খাতুন বিধবা হন। তারপর মাই আগলে রেখে মানুষ করেছেন ছেলেদের।
সৈয়দ হাসান ইমামের শিক্ষাজীবন শুরু হয় বর্ধমান টাউন স্কুলে। এরপর ১৯৫২-৫৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন রাজ কলেজে এবং ১৯৫৪-৫৭ সাল পর্যন্ত টেকনিক্যাল কলেজে।
১৯৫২ সালে ছাত্রাবস্থায় অল ইন্ডিয়া ইয়ুথ ফেস্টিভ্যালে রবীন্দ্রসংগীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন হাসান ইমাম। বর্ধমানে মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করে বিশেষ প্রশংসিত হন তিনি। ১৯৫৫ সালে কলেজের অনুষ্ঠানে গান শুনে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় তাকে বিনা পারিশ্রমিকে গান শেখানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তারপর মাত্র এক বছর তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতে তামিল নেন। রাজ কলেজে অধ্যয়নকালে সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও কমনরুম সম্পাদক নিযুক্ত হন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বর্ধমান জেলা গণনাট্য সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন হাসান ইমাম। ১৯৫৭ সালে বাংলাদেশে আসেন তিনি।
সৈয়দ হাসান ইমাম ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে যোগ দেন। ১৯৬০ সাল থেকে হাসান ইমামের অভিনয় জীবন শুরু। এ বছর থেকে তিনি চলচ্চিত্রে এবং ১৯৬৪ সাল থেকে টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করেন। তার প্রথম দিকের সিনেমার মধ্যে ‘রাজা এলো শহরে’, ‘শীত বিকেল’, ‘জানাজানি’, ‘ধারাপাত’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৫ সালে সমগ্র পাকিস্তানের চলচ্চিত্র উৎসবে হাসান ইমাম শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান লাভ করেন খান আতাউর রহমানের ‘অনেক দিনের চেনা’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য।
তিনি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষের কেন্দ্রীয় উৎসবে ডামা সার্কেল প্রযোজিত ‘তাসের দেশ’, ‘রাজা ও রানী’ এবং ‘রক্তকরবী’ নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী ছিলেন। বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি নাটকে নিয়মিত অভিনয় করেন। তার অভিনীত টিভির দুই শতাধিক নাটকের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি- মুস্তাফা মনোয়ার নির্দেশিত ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’, রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’, মোস্তফা কামাল সৈয়দ প্রযোজিত ‘স্বপ্ন বিলাস’ ইত্যাদি।
১৯৬৬-৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে তিনি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের মঞ্চে নাটক-নাটিকা ও গণসংগীত পরিচালনা করেন। হাসান ইমাম পরিচালিত নাটকগুলোর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’, সোমেন চন্দের ‘না’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের সময় সংস্কৃতি সংসদ আয়োজিত প্রায় ১০ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে বাংলা একাডেমীর বটমূলে মঞ্চায়িত ‘রক্তকরবী’ নাটকটি বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাসান ইমামকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় শিল্পীদের প্রতিবাদী সংগঠন বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ। যারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জন করেন। গণআন্দোলনের চাপে পাকিস্তানি সরকার ৮ মার্চ থেকে বেতার টেলিভিশনের দায়িত্ব বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চের পর হাসান ইমাম মুজিব নগর চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ১৯৭১-এ স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের নাট্য বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে নিযুক্ত হন।
সৈয়দ হাসান ইমাম মুজিবনগর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সালেহ আহমেদ নামে বাংলা সংবাদ পাঠ করতেন। হাসান ইমাম ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংবাদ পাঠ এবং নাট্য বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হানকে সভাপতি ও হাসান ইমামকে সাধারণ সম্পাদক করে মুজিব নগরে চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি গঠন করা হয়। যাদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দলিল ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নির্মিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠায় হাসান ইমাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন সৈয়দ হাসান ইমাম। ২০০১ সালে বিএনপি- জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসায় হাসান ইমাম দেশত্যাগে বাধ্য হন। দেশত্যাগের আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার সংসদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীসহ বহু সংগঠনের সভাপতি বা আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। হাসান ইমাম টেলিভিশন নাট্যকার, নাট্যশিল্পী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন দীর্ঘ ৩৮ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা চক্রান্তের ওপর আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’ পরিচালনার কাজেও তিনি নিয়োজিত ছিলেন। চলচ্চিত্রটি তার নির্দেশনায় সফলভাবে মঞ্চায়িত হয় ২০০৪ সালের ২৮ মার্চ লন্ডনের লোগান হলে।
হাসান ইমাম শিল্পী লায়লা হাসানকে বিয়ে করেন। লায়লা হাসানের বাবা আওয়াল সাহেব ব্যাংকে লেনদেনের কাজে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। এর মাধ্যমেই তিনি হাসান ইমামের সঙ্গে পরিচিত হন। পরবর্তীকালে তিনিই হাসান ইমামের শ্বশুর হন। এ প্রসঙ্গে লায়লা হাসান বলেন, ‘স্বামী হিসেবে হাসান ইমাম এক কথায় অতুলনীয়। যা প্রতিটি মেয়ের একান্ত কাম্য। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্বামী, বন্ধু, গাইড ও অভিভাবক। উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। ওর ঐকান্তিক অনুপ্রেরণা ও ইচ্ছা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে বাধ্য করেছে। বিবাহিত জীবনে শিল্পী হিসেবে যে প্রতিষ্ঠা আমি পেয়েছি তার মূলেও তিনিই।’
সৈয়দ হাসান ইমাম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ অবদানের জন্য সিকোয়েন্স পুরস্কারও লাভ করেন তিনি। তা ছাড়া বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদকসহ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন এ অভিনেতা। কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে হাসান ইমাম জুরির দায়িত্ব পালন করেন।
বিডি-প্রতিদিন/২৭ জুলাই ২০১৫/ এস আহমেদ