৭ জুন, ২০১৯ ১৬:৩৩

ইসিজি'র মেশিন রিপোর্টিং: ভয়াবহ বাস্তবতা

ডা. মাহবুবর রহমান

ইসিজি'র মেশিন রিপোর্টিং: ভয়াবহ বাস্তবতা

(বামে) প্রথম ইসিজি, যেখানে মেশিন বলছে নরমাল। (ডানে) মূল রক্তনালী ১০০% বন্ধ। রিং পরিয়ে দেয়ার পরে স্বাভাবিক প্রবাহ শুরু।

ঈদের মাত্র একদিন পার হল। সবাই ঈদের ফুরফুরে মেজাজে আছি। চেম্বার বন্ধ থাকায় কেবল সকালের রাউন্ড দিয়ে বাসায় ফিরেছি। জরুরি সমস্যা না থাকলে সন্ধ্যায় আর হাসপাতালে যাব না। রাতে ডা. কবীরের বাসায় ডিনারে যেতে হবে। কবীরের বউ ফ্লোরা শক্ত করে বলেছে, না গেলে কষ্ট পাবে। কেবল প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় আমার কর্তব্যরত কনসালটেন্ট ডা. রাশেদ ফোন করে জানালেন, পঞ্চাশ বছরের এক ভদ্রলোক সিসিইউ'তে কেবলই ভর্তি হয়েছেন একদিনের পেটে ব্যথা নিয়ে। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টার পেটে ব্যথা। এই ব্যথা নিয়ে বাসার পাশেই একটি জেনারেল হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখানকার জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁর একটি ইসিজিও করেছিলেন। কিন্তু সেটি নরমাল (?) থাকায় গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দিয়ে তাঁকে ছেড়ে দেন। প্রথমে মনে হল ব্যথা একটু কমে এসেছে। কিন্তু পরে তা আবার বৃদ্ধি পায়। এই ব্যথা নিয়ে তিনি বাসার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন কিন্তু বিকেলের দিকে পেটে ব্যথার সাথে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তাই আত্মীয়-স্বজন তাঁকে বাসার একশ গজের ভেতর আমার হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন।

আমার ইমারজন্সি মেডিকেল অফিসার একটি ইসিজি করেই বলে দিলেন রোগীর ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক হয়েছে! ডা. রাশেদ দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীর আত্মীয়-স্বজনের সাথে আলাপ করলেন। যদিও পেটে ব্যথা, কিন্তু এটি হার্টেরই ব্যথা। ইসিজি পরিষ্কার বলছে এটি হার্ট এ্যাটাক।

আমার ঈদের ডিনারকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতে সপে দিয়ে দ্রুত হাসপাতালে রওনা দিলাম। গিয়ে দেখি রোগীর এখনো তীব্র পেটের ব্যথা হয়ে চলেছে, হার্টবিট বেড়ে ১৩০, রক্তচাপ কমে গেছে। ইসিজি পরিশষ্কার হার্ট এ্যাটাক বলছে। আমি যতই বলি এটি হার্ট এ্যাটাক, রোগীর আত্মীয়-স্বজন বারবার পেটে ব্যথার কথা বলে চলেছেন। তাঁদেরকে বললাম যে, হার্টের ব্যথা পেটেও অনুভূত হতে পারে। ইতিমধ্যে মূল্যবান সময় পার হয়ে গেছে। এখনো যদি বন্ধ রক্তনালী খুলে দেয়া যায় তাহলে কিছু মাংসপেশি রক্ষা করা যেতে পারে। তাঁদের চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছায়া। কিন্তু যখন দেখলেন যে, রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে তখন বললেন যে, আচ্ছা ঠিক আছে অন্তত এ্যানজিওগ্রাম করেন। আমি তো জানি মূল রক্তনালী ব্লক হয়ে গেছে। তাই এ্যানজিওগ্রাম করে যখন তাঁদের দেখালাম যে, হার্টের মূল রক্তনালী (LAD) শতভাগ বন্ধ তখন তাঁরা বিশ্বাস করলেন এবং ব্লক খুলে দেবার অনুমতি দিলেন। তারপর আমরা মাত্র দশ মিনিট ব্যয় করে ব্লক খুলে একটি রিং (Stent) পরিয়ে দিলাম। রোগীর পেটের ব্যথাও দ্রুত কমে গেল।

তাহলে গতকালের অন্য হাসপাতালের ডা. সাহেব ইসিজি করা সত্ত্বেও হার্ট এ্যাটাক বুঝতে পারলেন না কেন? এর কারণ দু’টি। ১। রোগীর বুকে কোনো ব্যথা ছিল না। শুধু পেটে ব্যথা। ২। ইসিজি’র মেশিন রিপোর্টিং বলছে, নরমাল ইসিজি।

এখানেই সমস্যা। প্রথমত, হার্ট এ্যাটাক হলেই যে বুকে ব্যথা হবে এমন কোন কথা নেই। বুকে হতে পারে, বুকের আশেপাশে হতে পারে, হাতে, গলায়, নীচের চোয়ালে, দাঁতে, পেটে, পিঠের যে কোন জায়গায় ব্যথা, চাপচাপ ভাব, জ্বালাপোড়া, ভারি বোধ হওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া, ঘেমে যাওয়া, এমনকি সাময়িক অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত: হার্ট এ্যাটাকের ইসিজি সব ডাক্তারকে চিনতে হবে। অন্তত STEMI ECG, নইলে বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে হবে। একজন এমবিবিএস ডাক্তারকে ন্যূনতম STEMI ECG চিনতে হবে। এটি মিনিমাম যোগ্যতা। এর সাথে মানুষের জীবনমৃত্যু জড়িত।

আরেকটি ব্যাপার। মেশিন কর্তৃক ইসিজি রিপোর্টিং। প্রায়ই দেখা যায় এটি ভুল রিপোর্ট করে। আমার সব নবীন ও জুনিয়র চিকিৎসকদের বলব তোমরা এটি শিখে নিবে। খুব সহজ। আর ইসিজি’র গায়ে রোগীর নাম ও তারিখ অবশ্যই হাতে লিখতে হবে। নার্স বা টেকনিশিয়ানকে এ ব্যাপারে পরিষ্কার নির্দেশনা দিতে হবে। কেননা মেশিন আপডেটেট করা না থাকলে এলোমেলো তারিখ দেখাতে পারে। রোগীর নাম পরিষ্কার করে না লিখলে এক রোগীর ইসিজি ভুল করে অন্য রোগীর ফাইলে চলে যেতে পারে। সতর্ক না হলে তার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।

শেষ করব আরেকটি সতর্ক বার্তা দিয়ে। বুকে ব্যথা, পেটে ব্যথা, হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বা তীব্র ঘাম দিলে এমন একটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে হবে যেখানে ইসিজি বুঝবার মত চিকিৎসক আছেন। জেনারেল হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যেখানে সকালের রিপোর্ট বিকেলে বা বিকেলের রিপোর্ট পরের দিন সরবরাহ করা হয় সেখানে ইসিজি করাবেন না। তাৎক্ষণিক রিপোর্ট দিবে যেখানে, সেখানে যেতে হবে। কারণ হার্ট এ্যাটাক হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু করতে হবে। প্রতি মিনিটে অসংখ্য মাংসপেশির মৃত্যু ঘটে হঠাৎ মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। আর যাঁরা বেঁচে যাবেন তাঁরা দীর্ঘস্থায়ী হার্ট ফেইল্যুর নিয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হবেন।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট এবং সিসিইউ ইনচার্জ, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হসপিটাল।


বিডি-প্রতিদিন/০৭ জুন, ২০১৯/মাহবুব

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর