১. ভিক্টোরিয়া পার্ক আর সেন্ট ক্লেয়ারের ম্যাকডোনাল্ডস-এর কোনার দিকে বেশ কয়েকটি টেবিল এক সাথে জড়ো করে বসেছেন তাঁরা। বয়সের বিবেচনায় এরা সবাই সিনিয়র সিটিজেন। রাত বারোটায় সিনিয়র সিটিজেনরা দল বেঁধে এই ভাবে ম্যাকডোনাল্ডস-এ আড্ডা দিচ্ছেন- দৃশ্যটা খপ করে টেনে ধরলো যেন।
: দে আর হ্যাভিং মিড নাইট পার্টি- বর্ণমালা জবাব দেয়।
আমরা নিজেদের অর্ডার দেয়ার প্রস্তুতি নেই। আমরা মানে আমি আর বর্ণমালা। খাবারটা আসলে মুখ্য না, মুখ্য হচ্ছে কথা বলা। আমার কেন জানি মনে হয়েছে- মেয়েটার মনের ভেতর কিছু একটা ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘুরপাক খাওয়া কথাটার সহজেই বের হয়ে আসার পথ তৈরি করতেই মধ্যরাতে বাপ-বেটির ম্যাকডোনাল্ডস-এ ঢোকা।
: 'ডু ইউ থিংক এভরি স্টুডেন্ট নিড টু গেট হান্ড্রেড পার্সেন্ট?'– মুখ খুলতে শুরু করে বর্ণমালা।
: একদম না, আমার কাছে হান্ড্রেড পার্সেন্ট মার্কস এর কোনোই গুরুত্ব নেই। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মেয়েটা ক্লাস এনজয় করছে কী-না, পড়াশোনাটা এনজয় করছে কী-না।
: কিন্তু জানো, আমার ক্লাসের সব বন্ধুদের মাথায় কেবল গ্রেড, হান্ড্রেড পার্সেন্ট...এইসব। ওদের প্যারেন্টসরা তাই চায়।
: আমি একদমই চাই না।
মুহূর্ত দেরি না করে আমি উত্তর দেই। ‘তবে আমার একটা পয়েন্ট আছে। আমি বুঝতে চাই হান্ড্রেড পার্সেন্ট মার্কস এচিবঅ্যাবল কী-না, এচিবঅ্যাবল হলে তুমি ট্রাই দিচ্ছো কী-না। তুমি ট্রাই দিয়েছে কিন্তু পাওনি- আই অ্যাম হ্যাপি উইদ দ্যাট। আমার কাছে ‘ট্রাইটা’ গুরুত্বপূর্ণ।
২. বিকেলে বর্ণমালার স্কুলের চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই এমন একটা আলোচনার মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি ছিল আমার। চিঠিটা এসেছে বর্ণমালার নামে, সাথে ‘অ্যান্ড ফ্যামিলি’ দেখে চিঠিটা আমি খুলে ফেলি। প্রথম প্যারাটা পড়েই উচ্চস্বরে মেয়েকে ডাকতে শুরু করি।
- এটা কি?- ফান করার জন্যই চিঠিটা বর্ণমালার দিকে ধরে খানিকটা রাগতস্বরে জানতে চাই আমি।
- ‘অনার্স নাইট’- বর্ণমালার নির্লিপ্ত জবাব আমাকে বিস্মিত করে।
- তুমি জানো এটা?
- হ্যাঁ, স্কুলে হান্ড আউট করল।
- আমাদের বলো নি যে!
- নাথিং স্পেশাল বাবা। ক্লাসের আরো কয়েক জনই পেয়েছে এটা। বলার কিছু নেই।
বর্ণমালার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। এরা কোনো কিছুকে এতো নির্লিপ্তভাবে, এতো সহজভাবে নিতে শিখলো কিভাবে?
বর্ণমালার মুখের দিকে তাকিয়ে তার কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। স্কুলের প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপালের স্বাক্ষর করা চিঠিটায় চোখ রাখি... ''Congratulations on being a Bloor Collegiate Institute Award Winner and on being recognized at Honour’s Night'' একজন বাবার জন্য এই লাইনকটিই তো খুশি হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু মেয়ে কী-না পাত্তাই দিলো না!
আমি চিঠিটি পড়তে শুরু করি-‘Bloor Collegiate Institute has a long , proud tradition of academic excellence ; you have demonstrated the skills, the values, and the ability for great accomplishments at this school and beyond. Please invite your parents and friends to join us for Honour’s Night, which recognizes your achievement.’ যার কাছে স্কুল এই চিঠি পাঠিয়েছে তারই কোনো আগ্রহ নেই এই চিঠি নিয়ে।
৩.'তোমাকে একটা প্রশ্ন করি বাবা? গাড়ির পেছন থেকে কথা শুরু করে বর্ণমালা। আমি উৎসাহী হয়ে উঠি। চিঠিটা নিয়ে মেয়ের এতো নির্লিপ্ততার কারণ হয়ত জানা যাবে এবার।
'তুমি যদি কোনো এওয়ার্ড পাও, যদি কিছু এচিভ করে- তাহলে কি তা চিৎকার করে এক্সপ্রেস করতে হবে?
: ইট ডিপেন্ডস মা। অনেকে এক্সাইটমেন্টটা প্রকাশ করে ভিজিবল ওয়ে-তে। হয়ত সেটাই তার প্যাটার্ন। আবার কেউ কেউ হয়ত গুরুত্বই দেয় না।
: আমার ক্লোজ বান্ধবী আজ এওয়ার্ডের চিঠিটা হাতে পেয়ে ক্লাসেই 'ও-মাই গড আই ক্যান্ট বিলিভ দ্যাট আই এচিভড দিস’ বলে চিৎকার করে ওঠেছে।
: ওকি ভিন্ন কোনো এওয়ার্ড পেয়েছে? সাম থিং বেটার!
: আই ডোন্ট মাইন্ড বাবা। ও সেটা ডিজার্ভ করে, বাট এক্সপ্রেশনট...।
: আবারো বলি, সেটা একেকজনের প্যাটার্ন। বাই দ্যা ওয়ে, তোমার বান্ধবী যদি তোমার চেয়ে ভালো মার্কস, এওয়ার্ড পায় তাতে কিন্তু আমি খুশি, তোমারও খুশি হওয়া উচিত। হয়ত ওর কাছে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, ওর প্যারেন্টসদের কাছেও। আমার কাছে সেটা একদমই গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবারো বলি, আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তোমার ‘ট্রাইটা’।
সেন্ট ক্লেয়ারের রাস্তা ধরে গাড়ি চালাতে চালাতে নাম না জানা বর্ণমালার বান্ধবীটাকে মনে মনে অভিনন্দন জানাই। রাস্তার আলো আঁধারিতে পেছনের সিটে বসা বর্ণমালার মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। গ্রেড নিয়ে, মার্কস নিয়ে তার মনের মধ্যে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতার আকাংখা তৈরি হোক, সেটা আমি একদমই চাই না।
ফ্রন্ট-সাইডের দু'দিকের জানালা খুলে দিয়ে বাতাসের দিকে মুখ তুলে বর্ণমালাকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিস করে বলি- 'Congratulations on being a Bloor Collegiate Institute Award Winner'.
সেন্টক্লেয়ার রোডের বাতাস সেই অভিনন্দন বার্তাকে ছড়িয়ে দেয় ক্লিফক্রেষ্টের আকাশে আকাশে। আমরা এখন শহরের রাস্তা ধরে খানিকক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াব। কথামালা যার নাম দিয়েছে 'ড্রাইভ ওয়াক'।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/এ মজুমদার