২৮ মার্চ, ২০২০ ১৬:১৫

আপনি তাদের চাকর নন, তারাই বরং আপনাদের চাকর

ফরিদ কবির

আপনি তাদের চাকর নন, তারাই বরং আপনাদের চাকর

ফরিদ কবির

আমি সম্ভবত কিছুটা আজন্ম বেয়াদব। এ জীবনে খুব কম মানুষকেই আমি 'স্যার' বলে সম্বোধন করেছি। খুব অল্প বয়সে, এমনকি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে 'স্যার' সম্বোধন করতাম না। যেমন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, কায়সার হক-তাদেরকে 'ভাই' বলেই সম্বোধন করতাম। নিজের বিভাগের শিক্ষকদেরকে আর অন্য বিভাগের খুব সিনিয়র শিক্ষকদেরকেই কেবল 'স্যার' বলতাম। যেমন, কবীর চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে 'স্যার' বলেই সম্বোধন করতাম। আবার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে অনেকে 'স্যার' ডাকলেও আমি 'সায়ীদ ভাই' বলেই ডাকতাম।

সে সময় সরকারি যেসব কর্মকর্তার সঙ্গে মিশেছি, তাদের অনেকে সচিব পদমর্যাদার হলেও (যেমন, মনযুর-উল করিম, মোফাজ্জল করিম, এটিএম গিয়াসউদ্দিন, এজেডএম শামসুল আলম) তাদেরকে তখন 'ভাই' বলেই সম্বোধন করতাম। কখনো পুলিশ বা আমলাদের 'স্যার' বলে সম্বোধন করিনি। এখনো তাই করি।

কেবল আমার অফিসে আমাদের সভাপতি ও মহাসচিবকে 'স্যার' সম্বোধন করি। এছাড়া আরও দু'-একজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে 'স্যার' বলি। আমার এক সিনিয়র সহকর্মী তাদেরকে এভাবে সম্বোধন করতেন বলেই আমিও করতে বাধ্য হয়েছি, বলা যায়। নইলে অন্য অনেকের মতো তাদেরকেও 'ভাই' বলেই সম্বোধন করতাম। অল্প বয়সেই সম্ভবত আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সকলকে 'স্যার' সম্বোধন করা যায় না। করা ঠিকও না।

আমাদের দেশে ক্ষমতাশালী হলে, বিশেষ করে, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদেরকে অনেকেই 'স্যার' বলে সম্বোধন করেন। পুলিশ হলে তো কথাই নেই। সাধারণ এসআই-দেরকেও অনেকে 'স্যার' বলে সম্বোধন করেন। এই সম্বোধন পেতে পেতে সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশরা ধরেই নেন তারা সাধারণ মানুষের চাইতে বেশি কিছু। কেউ কেউ হয়তো মনে করেন, তারাই জনগণের মালিক!

করোনাভাইরাসের কারণে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছেন। জরুরি অবস্থা নয়। যে কোনো জরুরি দরকারে মানুষ রাস্তায় বেরোবে। কেউ দুটো পয়সা কামানোর জন্য, কেউ জরুরি পণ্য কেনার জন্য। কোনো পুলিশ, কোনো সেনা সদস্য, কোনো সরকারি কর্মকর্তারই অধিকার নেই রাস্তায় কোনো মানুষকে অযথা হেনস্তা করার। অকারণে একাধিক লোক বাইরে যাতে আড্ডা না দেয়, জমায়েত না হয়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করাই তাদের কাজ।

কিন্তু তারা তো নিজেদেরকে 'স্যার' অথবা 'ম্যাডাম' ভেবে বসে আছেন! এই সম্বোধনের কারণে তারা নিজেদেরকে 'বিশেষ কিছু' মনে করে বসেন। এই মানসিকতাটাই সমস্যার।

এই যে একটা পুঁচকে মেয়ে, সহকারী কমিশনার হয়েই নিজেকে জনগণের মালিক ভাবতে পারছে, সেটার জন্য দায়ী এই সম্বোধন। আর আমাদের সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা। অভাব প্রকৃত শিক্ষারও।

আপনি থানায় গিয়ে একজন পুলিশকে 'স্যার' বললে এক ধরনের আচরণ পাবেন। আর না বললে আরেক রকমের আচরণ পাবেন। আমলা বলেন, আর পুলিশ বলেন এরা সকলেই শক্তের ভক্ত, নরমের যম। একজন দরিদ্র মানুষের সঙ্গে তারা যে আচরণ করে তা কিন্তু একজন ভালো জামাকাপড় পরা আমার মতো উদ্ধত মানুষের সঙ্গে করবে না। আপনাকে নরম পেলেই আপনার ওপর তারা সওয়ার হবে। এ সুযোগ কখনোই তাদেরকে দেয়া উচিত নয়। আমি অন্তত দিই না।
আপনারাও দেবেন না। বয়সে ছোট হলে তাদেরকে সোজা নাম ধরে ডাকবেন। বয়সে বড় হলে বড়জোর 'ভাই' বলতে পারেন। অথবা নামের সঙ্গে যোগ করতে পারেন 'সাহেব'! নো 'স্যার'!

নিজের শিক্ষক বা শিক্ষকতুল্য মানুষকে এই মর্যাদা দেবেন। আর, বড় জোর, নিজের প্রতিষ্ঠানের বসকে। (এটা আমাদের দেশের করপোরেট সংস্কৃতির অংশ। চাইলেও বাদ দিতে পারবেন না)। এর বাইরে আর কাউকে 'স্যার' ডাকা একেবারেই উচিত না।

আর, আমলা বা পুলিশদের তো নয়ই। আপনি তার অধীনে চাকরি না করলে কেন তাকে খামোখা 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' ডাকতে যাবেন? আপনি তাদের চাকর নন। সংবিধান অনুযায়ী তারাই বরং আপনাদের চাকর। কেউ আপনার ওপর আঙুল বা লাঠি তুললে তার আঙুল ভেঙে দিন। লাঠিটাও। আপনার কোনো অন্যায় হলে তার শাস্তি আদালত নির্ধারণ করে দেবে। কোনো শারীরিক নির্যাতন করার অধিকার পুলিশ বা আমলাদের নেই। নেই কোনো রকম অমর্যাদা করার অধিকারও।

রাস্তায় বা অন্য কোথাও সাধারণ মানুষের ওপর কোনো অন্যায় আচরণ ঘটতে দেখলে প্রতিবাদ করুন। না পারলে সেটার ছবি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করুন। ছড়িয়ে দিন সর্বত্র। আজ যে সহকারী কমিশনারের শাস্তি হলো, সেটা কিন্তু ফেসবুকে ব্যাপক প্রতিবাদের কারণেই।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: সাংবাদিক

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর