২০ ডিসেম্বর, ২০২০ ০৮:২৫

এক একটা আঘাত এক একটা নতুন স্বপ্ন গড়ে দেয়

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

এক একটা আঘাত এক একটা নতুন স্বপ্ন গড়ে দেয়

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

আঘাত মানুষকে কষ্ট দেয় না মানুষকে বদলে দেয়। কথাটা অদ্ভুত মনে হলেও সত্য। যেটাকে আমরা আপাত দৃষ্টিতে নেতিবাচক শব্দ হিসেবে দেখি সেটার ইতিবাচক শক্তি নেতিবাচক শক্তির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা যা দেখি তা ভাবিনা। আবার আমরা যা ভাবি তা দেখিনা। আঘাতটাও ঠিক এমন একটা বিষয়। যেটাকে দেখা যায়না, ভাবা যায়না কিন্তু সেটা এসে আবার দেখা ও ভাবনার দরজায় এসে কড়া নেড়ে কিছু বলে যেতে চায়। সেটা হয়তো অনেক কঠিন, অনেক বাস্তব তারপরও সেটাতে উপসংহার টানাটা ঠিক নয়।  

না শব্দটাকে প্রথম দেখাতে নেতিবাচক মনে হতে পারে। কিন্তু না শব্দটার মধ্যে ইতিবাচকতার প্রভাব এতটাই বেশি যে সেটাকে কোনো গন্ডির মধ্যে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। তারপরও হা বলাটা যতটা   সহজ না বলাটা ততটাই  কঠিন। আঘাতকে যখন আমরা না বলি তখন আঘাতটা চিৎকার  করে জানিয়ে দেয় সে কতটা মহামূল্যবান হয়ে উঠতে পারে। অনেকটা রহস্য হয়তো আঘাতে থাকে, অনেক আধো আলোয় আবছা ছায়াও হয়তো তাতে থেকে যায়, তবু কিছু অব্যক্ত সুর সেখানে দোতারা বাজায়। যেমন কবি শঙ্খ ঘোষ বলছেন- 

হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়
এ কথা খুব সহজ, কিন্ত কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়...

পৃথিবীতে কোনো কিছুই সহজ নয়। সহজ কথাটাও অনেক কঠিন। অনেকটা শক্ত পাথরের মতো। অনেকটা কাচ দিয়ে কাটা অসহায় হীরার মতো। যা  বুকটার টুটি  চেপে ধরে আঘাতে আহত মানুষের মানুষটাকে জাপটে ধরে। আঘাতের পর আঘাত তখন মানুষকে মানুষ হয়ে উঠবার প্রেরণা যোগায়। তখন  আঘাত যতটা কঠিন বলে মনে হয় আঘাতের উল্টো পিঠটা ঠিক ততটাই  সহজ হয়ে উঠে। আঘাত পেয়ে মানুষের চোখের জল যখন মাটিতে গড়িয়ে পড়ে তখন কঠিন পাহাড়ের আঘাতের বোঝাটা হালকা হয়। হালকা মানুষের হালকা মনে তখন অনেক নতুন পথের স্বপ্ন তৈরী হয়। 

একটা ক্ষুধায় কাতর মানুষ যখন একমুঠো ভাতের জন্য মানুষের দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয় তখন সে আঘাত প্রতিঘাত হয়ে তাকে বেঁচে থাকবার  পথ দেখা। সে পথটা হয়তো অনেক কঠিন কিন্তু সে পথকে জয় করা অসম্ভব কিছু নয়। একটা ক্ষুদার্ত মানুষই পারে খাদ্যের মূল্য বুঝতে। সে বোঝার জ্ঞানটা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, বিতাড়িত করে। তার ক্ষুধার জ্বালা থেকে তৈরি হয় নতুন ফসলের  উৎসব। নতুন চিন্তার উৎসব। 

যেমন- একদিন আমাদের দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন ছিলোনা। বাইরের  দেশ থেকে খাদ্য  আনতে হতো। এই না পারার আঘাত বিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। সে ভাবনা সৃষ্টি হয়ে নতুন নতুন জাতের খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিজ্ঞানীদের তাড়িত করেছে। আজ আমাদের দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন। এখন আর আমদানি নয় আমাদের দেশ খাদ্য রপ্তানিও করছে। এটাই আঘাতের শক্তি। যে আঘাত যত বড় সে আঘাতের  শক্তি তত জোরালো।

যেমন- একটা অদ্ভুত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এনে দেশি বিদেশী শক্তি বললো পদ্মা সেতুতে তারা আর অর্থায়ন করবেনা। একটা স্বপ্নের একপা দুপা করে  যাত্রার শুরুর আগেই কত বড় একটা আঘাত, অনেকটা বড়। যেন মেরুদন্ডটা ভেঙে পড়ার মতো। বুকের পাঁজরগুলো মোচড় দিয়ে উঠা কষ্টের মতো। কিন্তু কঠিন এ আঘাত ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে অসীম শক্তিতে পরিণত  হলো। আমাদের প্রানপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আঘাতকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন। দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন- আমরা নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু গড়ে তুলবো।

সবাই ভেবেছিলো হয়তো এটা বলার জন্য বলা। কিন্তু মানুষ তখন যা  ভেবেছিলো এখন তা মিথ্যা প্রমাণিত হলো। কারণ আঘাত যে প্রাণশক্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারে। পাহাড় ভেঙে যদি গড়ে। পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্পানটি যুক্ত হয়ে দুই তীরের মেলবন্ধন ঘটালো। বিস্মিত হলো সারা বিশ্ব। একটা  বড় আঘাত আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো ইতিবাচক শক্তি গড়ে তুললো। যে শক্তি অমূল্য, মহাসম্পদ। মহিমান্বিত। প্রফুল্ল রায়ের থ্রিলার উপন্যাস আঘাত। যে উপন্যাসে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে নানা ঘাত প্রতিঘাত এবং লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।

মানুষের জীবনে আঘাতটাও তেমনি থ্রিলার উপন্যাসের মতো। যা হেটে হেটে যায় তবে শেষটা কি হবে হয়তো তা কেউ জানেনা। কেউ কেওই বলেন অস্ত্রের আঘাত শুকিয়ে যায় কিন্তু কথার আঘাত শুকায় না। না শুকানোই ভালো। কারণ একটা তরতাজা আঘাত মানুষকে হয়তো সাময়িক কষ্ট দেয়। তবে সেই কষ্ট একদিন মানুষকে বাস্তবতা শিখিয়ে দিয়ে খাঁটি সোনা বানায়।

আমরা মানুষ। খুব সাধারণ হয়তোবা একটু আঘাতের ধাক্কা খেয়ে ভাবি, আঘাত এলে আমরা ভেঙে পড়বো। হারিয়ে যাবো। কিছুই আর থাকবেনা। এটা আসলে আমাদের ভাবনা কিন্তু ভাবনাটা যদি জেদ হয়ে ইতিবাচক মনটাকে জাগিয়ে তোলে তখন আঘাত ভেঙে ভেঙে ইতিহাস গড়ে। সে ইতিহাসের পথ মাড়িয়ে মানুষ হেটে যায় বিজয়ের পথে। স্বপ্নের পথে। যে স্বপ্নটা স্বপ্ন নয়, স্বপ্নের চেয়ে আরো বড় কিছু। যা প্রতিদিনের ছোট ছোট আঘাতে মানুষকে মানুষ বানায়। তখন মানুষ স্বপ্নের পিছনে ছোটেনা, স্বপ্ন মানুষের পিছনে ছোটে। 

গ্রামের  রাস্তা পেরিয়ে আঘাত শহরের রাস্তায় নামুক। এরপর শহরের পর শহরে তারাবাতির উজ্জ্বল আলোয় আঘাত  প্রত্যাখ্যাত হয়ে মহাবিশ্বের কোথাও এসে মহাবিস্ময় তৈরী করুক। কপালে ভাঁজ পড়া মানুষের কপলাটা প্রচন্ড  আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে ভাগ্যের চাকাটা ঘুরিয়ে ফেলুক চোখের পলকে। যেমন বদলে চলেছে আঘাতে বদলে যাওয়া মানুষের দিনপঞ্চি আর ঘড়ির কাটা। আঘাত থেকে শিক্ষা নিতে হয়, নিজেকে কংক্রিটের মতো ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয়। ভাঙা গড়া, উত্থান পতন, ঘাত প্রতিঘাত থাকুক না কেন। সময়ের কাছে সেটাই মানুষ শিখুক যেটায় আঘাত আছে। ফুলের যেমন কাটা আছে।


(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)


বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর