শিরোনাম
১৪ মে, ২০২২ ১২:৩০

গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন: পৃথিবীর রূপ

ডা. মাহবুবর রহমান

গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন: পৃথিবীর রূপ

জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে  যাই না আর।”  কিন্তু গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখার পরে জীবনানন্দ এই প্রতিজ্ঞা ধরে রাখতে পারতেন কিনা জানি না। তবে আমি রাখতে পারি নি। পৃথিবীর রূপ দেখতে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে লাস ভেগাস হয়ে আরিজোনা অঙ্গরাজ্য লক্ষ্য করে যাত্রা শুরু করলাম।

পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চর্যের একটি হলো গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। ২৭০ মাইল দীর্ঘ, ১৮ মাইল প্রস্থ এবং ১ মাইল গভীরতার এই বিস্ময়কর সুন্দর স্থাপনাটি পৃথিবী নিজের হাতে তৈরি করেছে এখন থেকে ৬০ লক্ষ বছর আগে। হঠাৎ মনে হবে আপনি মঙ্গল গ্রহের এক বিশাল জলশূন্য সাগরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সম্মুখে সারি সারি লোহিত পাহাড় সাগরবক্ষ ভেদ করে আকাশের দিকে উঁকি মারছে। ক্ষণে ক্ষণে মধুর দমকা হাওয়া এসে আপনাকে মনে করিয়ে দিবে, না, আপনি এই সুন্দরতম গ্রহ পৃথিবীর বুকের উপরেই রয়েছেন। যখনই আরেকবার এই বিশাল জলশূন্য জলাধারের দিকে তাকাবেন তখন আপনার অতীত আর অনাগত ভবিষ্যৎ ভুলে গিয়ে শুধু অপার সুন্দর বর্তমানের মোহজালে আটকে যাবেন নিশ্চিত।

নেভাদা অঙ্গরাজ্যের রাজধানী লাস ভেগাস থেকে সকাল ৮টায় সহধর্মিনী ও কন্যাকে নিয়ে আমাদের ট্যুরিস্ট বাসটি ছাড়ল। লাস ভেগাসের রাতের মোহনীয় রূপের কথা সবাই জানেন। যার যেরকম আনন্দ দরকার তার সবটুকু উপকরণ এখানে আছে। এখানে পকেটে ডলার ভরে নিয়ে আসায় কোন বাধা নেই, তবে ডলার ফেরত নিয়ে কেউ ফিরে গেছে এমন রেকর্ড কেউ সৃষ্টি করতে পারেনি। তবে বোন শেলী আর হাফিজ ভাইয়ের শর্তহীন এবং অকৃত্রিম আদরযত্নে লাস্যময়ী লাস ভেগাসের কোমনীয় রূপটি আমরা উপভোগ করতে পেরেছি। নৈশনগরীর কৃত্রিম সুখ পেছনে ফেলে শেষ পর্যন্ত আমরা পৃথিবীর আদি সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য বেরিয়ে পড়লাম।

পার্শ্ববর্তী রাজ্য আরিজোনার উত্তর প্রান্তে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের অবস্থান। পাঁচ ঘণ্টার যাত্রা শুনতে লম্বা হলেও এয়ারপোর্টের রানওয়ের মতো সুমসৃণ রাস্তা, দু'দিকে বিস্তীর্ণ ছোট ছোট গুল্ম দিয়ে ঢাকা উন্মুক্ত প্রান্তর, অদূরে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি আর কিছুক্ষণ পরপর চা বিরতি আপনার যাত্রাকে আনন্দময় ও সুখকর করে তুলবে।

পথে নানান ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী স্থাপনা যেমন কলোরাডো নদীর উপর ১৯৩১ সালে নির্মিত হুবার ড্যাম আপনাকে বিস্মিত করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে আমেরিকার পরমাণু বোমার প্রথম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ আরিজোনার মরুভূমিতেই হয়েছিল। এসব বিবরণ আপনি টুরিস্ট বাসের ধারাভাষ্যকারের জবানে পাবেন। দীর্ঘ এই ক্যানিয়নের উত্তর প্রান্ত (north rim) এবং দক্ষিণ প্রান্ত (south rim) হলো পর্যটকদের সবচেয়ে প্রিয় স্থান। আমরা দক্ষিণ প্রান্ত বেছে নিলাম।

সবাই জানেন, একসময় এই দেশটি এখানকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের অধীনেই ছিল। তাদেরকে নিজভূমি থেকে উৎখাত করে, নির্যাতন করে, হত্যা করে ইউরোপিয়ানরা তাদের আধিপত্য গড়ে তোলে। ১৫৪০ সালের দিকে প্রথমে স্প্যানিশরা এখানে আসে। এখানে প্রাপ্ত গুহাচিত্র ও অন্যান্য প্রত্ন নিদর্শন পরীক্ষা করে জানা গেছে, প্রায় ১২০০০ বছর আগে এখানে মনুষ্য বসতি ছিল। যেটা ছিল সর্বশেষ বরফ যুগের পরবর্তী সময়। এখানে প্রাপ্ত ডাইনোসর ও বিশালাকার হাতির মতো দেখতে ম্যামথের দেহাবশেষ সেই সাক্ষী দিচ্ছে। এসবের বাস্তব প্রমাণ দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে নিউ ইয়র্ক শহরের সেন্ট্রাল পার্কের পশ্চিম পাশে অবস্থিত ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে।

সে যাই হোক। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন অঞ্চলে অনেকগুলো আদিবাসীর বসবাস ছিল। তারমধ্যে  Paiute, Navajo, Zuni এবং Hupi জনগোষ্ঠী অন্যতম। বর্তমানে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া হাভাসুপাই (Havasupai) আদিবাসীরা দাবি করছে যে, উপরোক্ত আদিবাসীদের উত্তরপুরুষ তারাই। গত ৮০০ বছর ধরে হাভাসুপাই আদিবাসীরা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে বসবাস করে আসছে। 

কী আছে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে?
বিস্ময়কর এই বিশাল গর্তটি পৃথিবীর সৃষ্টির এক আদিম পাঠশালা হয়ে আছে। প্রায় চল্লিশটি শিলাস্তর পৃথিবীর উপরিভাগের ত্বককে গঠন করেছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে খাড়া এক মাইলের গভীরতায় সেই সব শিলাস্তর উন্মুক্ত হয়ে আছে ভূতত্ববিদদের কাছে। সর্বনিম্নের স্তরটি ১ কোটি ৭০ লক্ষ বছর আগে গঠিত। ভূতত্ববিদরা এর নাম দিয়েছেন বিষ্ণু শিলাস্তর (Vishnu Basement Rocks) । আপনি চাইলেই ভূতল থেকে পাঁচঘণ্টা হাইকিং করে ১ কোটি ৭০ লক্ষ বছর পুরানো বিষ্ণু দেবকে দেখে আসতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে বিষ্ণু দেব এর রূপ প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ৮০০ জন পর্যটক পরপারে যাত্রা করেছেন, যাঁদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানও হতে পারেনি। 

কীভাবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন গঠিত হল?
এই প্রশ্নের কোন সহজ উত্তর নেই। বৈজ্ঞানিক উপাত্ত এই ধারণা দেয় যে, গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের তলদেশ একসময় সাগরের তলদেশের সাথে সংযুক্ত ছিল। ভূত্বকের টেকটোনিক প্লেটগুলো ভূমিকম্পের ফলে নড়েচড়ে নতুন করে বসে। ফলে এই অংশটি সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে আটকে পড়া পানি জমে বরফ হয়ে একসময় বাষ্প হয়ে উবে যায়। পেছনে পড়ে রইল জলশূন্য হাহাকার। পৃথিবীর এই হাহাকার দূর করতে জন্ম নিল কলোরাডো নদী। তার প্রবাহে, ঘর্ষণে দিনে দিনে ক্যানিয়নের আকার বড় হতে থাকে। আর দক্ষিণপশ্চিমের সাত সাতটি রাজ্যের তৃষ্ণা মিটিয়ে কলোরাডো নিজে ক্যালিফোর্নিয়া উপসাগরের গহীনে ডুব দিয়েছে। এই সাতটি অঙ্গরাজ্যের কৃষি, কৃষ্টি আর বেঁচে থাকা এই কলোরাডো নদীর উপর নির্ভরশীল।

গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সৌন্দর্য সরাসরি না দেখলে এর ব্যাপ্তি মস্তিস্কে আসে না। এক কোটি সত্তর লক্ষ বছরের পৃথিবীর মায়াবী মুখ আপনার সামনে। কত ইতিহাস, কত করুণ গাঁথা লেখা আছে তার বক্ষপিঞ্জরে,  কত সুখময় গোধূলির সিঁদুর চিহ্ন আঁকা আছে তার ললাটে!

স্থিরচিত্র বা ভিডিওতে এর গভীরতা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। যত দেখি ততই দেখতে ইচ্ছে করে। মন চায়  আরেকটু একা নিবিড়চিত্তে অনুভব করি। লালপাহাড়ে সূর্যের রক্তিম চুম্বন আরেকটুখানি অবলোকন করি।  ইউটিউব, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলসহ ভার্চুয়াল মিডিয়াতেও আপনি দেখে নিতে পারেন। কিন্তু ভুক্তভোগীরাই কেবল জানেন ভিডিও দেখে কুরবানির গরুর স্বাস্থ্য আর বিয়ের পাত্র-পাত্রী নির্বাচন কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ!
১২ মে, ২০২২। লাস ভেগাস, যুক্তরাষ্ট্র

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর