বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অশ্রু ও কষ্টের পাহাড়ে দীপনের পরিবার

লাকমিনা জেসমিন সোমা

রাত ১১টার পর কলিংবেল বাজলেই ফরিদা প্রধান বুঝতে পারতেন, দীপন এসেছে। শুক্রবার রাতেও বুঝতে পেরেছিলেন। তাই, নিজে গিয়েই দরজা খুললেন। দীপনকে দেখে এও বুঝলেন, ‘ছেলের আজ মন খারাপ।’ কেবল বুঝতে পারেননি আদরের সন্তান তার মায়ের কাছে এসেছে শেষ বিদায় নিতে। গতকাল রাজধানীর পরীবাগে নিজ বাসায় বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের মা ফরিদা প্রধান তার ছেলের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের এক হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দেন। দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া বললেন, ভেতরটা গুমরে মরছে। পাথর চাপা দিয়ে রেখেছি। আমি  শক্ত না হলে আমার ছেলে যে পরীক্ষা দিতে পারবে না। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দীপনের মা-বাবার বুকে হাহাকার চলছে। দীপনের একমাত্র ছেলে এবার জেএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। তাকে নিয়ে কষ্টের পাহাড় পাড়ি দিতে হবে স্ত্রী ডা. রাজিয়াকে। যেন সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছেন তিনি। দীপনের মা ফরিদা প্রধান বলেন, দীপন প্রায় প্রতিদিনই রাতে নিজের বাসায় ফেরার আগে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত। আমার পাশে বসে একটু গল্প-গুজব করত। কী রান্না করছি দেখত। ওর পছন্দের কিছু রান্না করলে খেত। তারপর চলে যেত। আমি নিজে দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায় দিতাম। দীপনের মা বলেন, সর্বশেষ গত শুক্রবার (খুন হওয়ার আগের দিন) রাতে বাসায় এসেছিল দীপন। কিন্তু সেদিন ওকে দেখে আমার কেমন যেন লাগল। মনে হলো মনটা ভীষণ খারাপ। বেশ শান্ত-শিষ্ট। চুপচাপ আমার পাশে বসে রইল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা তোর কি মন খারাপ? তেমন কিছুই বলল না সে। বলল, না মা, কিছু হয়নি, সবই ঠিক আছে। কিছুক্ষণ পর ওর বোনের বাসায় যাবে বলে উঠে পড়ল। আমিও বাধা দিলাম না। দরজা খুলে দিলাম। ছেলে বলল, দরজা লাগিয়ে দাও। তবুও দাঁড়িয়ে থাকলাম। দাঁড়িয়ে দেখলাম ছেলে আমার চলে যাচ্ছে। লিফট না আসা পর্যন্ত দরজায় দাঁড়িয়েছিলাম। লিফট এলো, দীপন উঠল। তারপর লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার সময় দীপন শেষবারের মতো বলল, মা তুমি যাও তো! ছেলের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের এই বর্ণনা দিতে গিয়ে গলা ভারি হয়ে আসে ফরিদা প্রধানের। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, তখনো বুঝিনি এটাই দীপনের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। বুঝিনি, ছেলে আমার শেষ বিদায় নিতে এসেছিল তার মায়ের কাছে। ও মারা যায়নি, ওকে মেরে ফেলা হয়েছেÑ চোখ মুছতে মুছতে বলেন মা ফরিদা। তিনি বলেন, আমার দীপন সৎ এবং ভালো মানুষ ছিল। সে তার নিজের পরিচয়েই পরিচিত ছিল। এ জন্যই বিশ্বাস রাখি। অশ্র“ভেজা চোখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক বলেন, বিচার চেয়ে লাভ কী? আমার ছেলে কি ফিরে আসবে? ফিরে আসবে না। কতজনকেই তো হত্যা করা হলো, বিচার হলো কই? তারপরও আমার ছেলের অছিলায় যদি বাকিদের বিচার হয়, তবে ভালো। চোখ মুছতে মুছতে এক আত্নীয়ার সঙ্গে নিজ ঘরে ফিরে গেলেন তিনি। গতকাল এই বাড়িতে দেখা যায় সুনসান নীরবতা। কিছুক্ষণ পরপর দু-একজন আত্নীয়স্বজন কিংবা শুভানুধ্যায়ী আসছেন। চুপচাপ বসে থেকে চলে যাচ্ছেন। যেন সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন সবাই।

শোকে পাথর দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া : কিছুক্ষণ পর ছেলে রিদাতের জেএসসি পরীক্ষা। তাকে প্রস্তুত করে দিচ্ছেন মা রাজিয়া। এ ঘর ও ঘর ছোটাছুটি করছেন তিনি। নিজের সর্বোচ্চ মানসিক বলটুকু দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন। যেন কিছুই হয়নি। ছেলেকে প্রস্তুত করে দেওয়ার এক ফাঁকে বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে এসে নিহত দীপনের স্ত্রী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক ডা. রাজিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমার বাহিরটা এমন দেখছেন, ভেতরটা গুমরে মরছে। পাথর চাপা দিয়ে রেখেছি। আমি শক্ত না হলে আমার ছেলে যে পরীক্ষা দিতে পারবে না। চোখ মুছে আবার ছেলের কাছে ছুটলেন তিনি। তারপর ছেলেকে পরীক্ষার হলে পাঠানোর সময়। বললেন, ‘বাবা, ভালো করে পরীক্ষা দিস।’ রিদাত নিচে নেমে গেল। দরজা থেকে এসে জানালায় দাঁড়িয়ে ছেলের গন্তব্য পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন ডা. রাজিয়া। এরপর তাদের সান্ত্বনা দিতে আসা এক শুভানুধ্যায়ী সিনিয়র চিকিৎসককে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন তিনি। যেন অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছিলেন। বললেন, ‘আমাকে মাফ করেন ভাইয়া, আমি দীপনকে বাঁচাতে পারলাম না।’ ডা. রাজিয়ার আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠল পুরো ডাক্তার বাড়ি। বিলাপ করতে করতে রাজিয়া বললেন, আমি ওকে দেখতে চাইনি। এই দীপনকে আমি দেখতে চাইনি। সুখের স্মৃতিগুলো নিয়েই আমি থাকতে চেয়েছি। আমি ডাক্তার হিসেবে নিজে অনেক পোস্টমর্টেম করেছি। কিন্তু দীপনের পোস্টমর্টেম হওয়া লাশ আমি দেখতে চাইনি। আমাকে মাফ করেন... আমি ওকে বাঁচাতে পারলাম না। ছেলে রিদাত ও মেয়ে রিদমাকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলের প্রফুল­ ভবনের ‘ডাক্তার বাড়ী’ নামে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন দীপন।

 

সর্বশেষ খবর