বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নতুন ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্র

নিউইয়র্ক প্রতিনিধি

নতুন ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্র

নিউইয়র্কের চাপ্পাকুয়া কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর স্বামী বিল ক্লিনটনের সঙ্গে হিলারি। নিউইয়র্কেরই একটি কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর স্ত্রী মেলানিয়ার সঙ্গে ট্রাম্প —এএফপি

পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশ করছে এক নতুন ইতিহাসে। প্রথমবারের মতো একজন নারী প্রেসিডেন্ট এখন যুক্তরাষ্ট্রের দোরগোড়ায়। গতকাল সারা দিনের ভোট গ্রহণ শেষে প্রয়োজনীয় ইলেকটোরাল পয়েন্টে স্পষ্ট পার্থক্য নিয়ে এগিয়ে ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় ডেমোক্রেট হিলারি ক্লিনটন ২০৩ ও রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৬৪ ইলেকটোরাল পেয়েছিলেন। তবে যেসব সুইং স্টেটের ভোট নিয়ে ছিল বেশি চিন্তা, সেসব স্থানেও এগিয়ে যাওয়ায় হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট হওয়া প্রায় নিশ্চিত। অবশ্য আজ বাংলাদেশে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস থেকে কত দূরে অবস্থান করছেন। আর কে হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, মঙ্গলবার মার্কিন স্থানীয় সময় সকাল ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে অঙ্গরাজ্যগুলোয় ভোট গ্রহণ শুরু হয়। অবশ্য নেভাদায় ভোট গ্রহণ দেরিতে শুরু করার অভিযোগে মামলা ঠুকেছে ট্রাম্প শিবির। ভোটের আগ মুহূর্তে বিভিন্ন জনমত জরিপে বলা হয়েছে, রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের জয়ের সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। সোমবার প্রকাশিত রয়টার্সের জরিপে বলা হয়েছে, হিলারির জয়ের সম্ভাবনা গত সপ্তাহের মতোই রয়েছে। সিএনএন বিভিন্ন স্টেট থেকে তাদের প্রতিনিধির পাঠানো সংবাদের মাধ্যমে জানান দিচ্ছে হিলারির এগিয়ে থাকার খবর। ইতিমধ্যে হিলারি শিবিরে স্বস্তির আভাস মিলেছে।

এর আগে, রাত ১২টা ১ মিনিটে আনুষ্ঠানিক ভোট গ্রহণ শুরু হয় নিউ হ্যাম্পশায়ারের ছোট্ট তিন শহরে। এ তিন শহরের ফলাফলে হিলারির চেয়ে এগিয়ে ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে বড় রাজ্যগুলোয় ভোট শুরু হওয়ার পর বুথ ফেরত জরিপে হিলারির পাল্লাই ভারী দেখা যায়। ভোট শুরুর ছয় মিনিটের মধ্যে ভোট দেন হিলারি ক্লিনটন ও তার স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ভোটের সকালে হিলারি টুইট করেন, ‘বসে থাকবেন না কেউ, ভোট দিতে যান।’ আর ট্রাম্প টুইট করেন, ‘আজ আমরা আবার যুক্তরাষ্ট্রকে শ্রেষ্ঠ আসনে নেব।’

অন্য যে কোনো বারের তুলনায় এবারের নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ তুঙ্গে। গতবার ৫৭ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এবার এ সংখ্যা বেড়েছে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে। গতকাল বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রেও তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ৬টায় ভোট শুরু হওয়ার আগে ভোটাররের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আরও দীর্ঘ হয়েছে। অনেক কেন্দ্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ভোটারদের। কিছু কিছু কেন্দ্রে দুই ব্লক পর্যন্ত লম্বা লাইন দেওয়া ভোটাররা অপেক্ষা করেন ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য। এর আগে আগাম ভোট দিয়েছেন ৪ কোটি ২০ লাখ মার্কিনি। আগাম ভোটে লাতিনো ভোটারদের উপস্থিতি ছিল অন্য যে কোনো বারের তুলনায় বেশি। আরিজোনা অঙ্গরাজ্যে গতবারের তুলনায় লাতিনো ভোটারদের উপস্থিতি ২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৩ শতাংশ। টেক্সাসে বেড়েছে ২৬ শতাংশ। আর ফ্লোরিডায় বেড়েছে নজিরবিহীন ১৫২ শতাংশ। ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন তার স্বামী বিল ক্লিনটনের সঙ্গে ভোট শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে নিউইয়র্কে তাদের বাড়ির পাশের চাপ্পাকুয়ায় ভোট দেন। এ সময় উপস্থিত ভোটাররা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। হিলারি হাত নেড়ে জবাব দেন। কয়েকজন ভোটারকে জড়িয়ে ধরেন। হিলারির রানিংমেট ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী টিম কেইন নিজের শহর রিচমন্ডে সস্ত্রীক ভোট দেন। ভোর ৬টায় তিনি নিকটতম কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে উপস্থিত হন।

নির্বাচন সামনে রেখে মার্কিন কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করে। নিউইয়র্কের ১ হাজার ২০৫ ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তায় ৫ হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এর মধ্যে অনেকের কাছে ছিল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং বিস্ফোরক শনাক্তকরণ যন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রের আইন মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, তাদের নাগরিক অধিকার বিভাগ ২৮টি অঙ্গরাজ্যে ৫ শতাধিক ভোট পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছে। এ ছাড়া ভোট কেন্দ্রগুলোয় উপস্থিত ছিলেন ভোটাধিকার কর্মী, রক্ষণশীল ওয়াচডগস ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা। ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকা থেকে যাওয়া পর্যবেক্ষকরা ভোট কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেন। ভোট চলাকালে বিশ্বগণমাধ্যম সরাসরি ভোটের আপডেট প্রচার করেছে। উৎসবমুখর পরিবেশে নারী, পুরুষ, ছেলে, বুড়ো সবাই গতকাল ছুটেছেন নিকটস্থ ভোট কেন্দ্রে। ইতিহাস রচনা করে মার্কিনিরা ব্যালটে বেছে নিয়েছেন নিজেদের নতুন প্রেসিডেন্ট। এটা শুধু মার্কিনিদের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য এক নতুন যুগের সূচনা। সে কারণেই মার্কিন মুলুকে চোখ ছিল পুরো বিশ্বের। এ ইতিহাসের সাক্ষী মার্কিনিদের পাশাপাশি বিশ্বনাগরিকরাও।নানা কারণেই এবারের মার্কিন নির্বাচন ইতিহাস। সোয়া দুইশ বছরের স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো নারী প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। এবার হলে নতুন ইতিহাসেই ঢুকে যাবে আমেরিকা। অবশ্য হিলারিকে ফার্স্ট লেডি, সিনেটর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকায় দেখেছে বিশ্ব। ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের প্রধান শহর শিকাগো থেকে ১৫ মাইল উত্তর-পশ্চিমে পার্ক রিজ শহরে ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর হিলারির জন্ম। বাবা হিউ রডহ্যাম ছিলেন নৌবাহিনীতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। ইলিনয়ের মেইন ইস্ট হাইস্কুলে চার বছর পড়েন হিলারি। এক বছর পড়েন মেইন সাউথ হাইস্কুলে। ছিলেন গার্ল স্কাউট। স্কুলে মেয়েদের ফুটবল লিগেও খেলেছেন। ১৯৬৯ সালে ওয়েলেসলি কলেজের সিনিয়র ক্লাস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। একই বছর কলেজের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে বক্তৃতা দিতে তাকেই বাছাই করেন সহপাঠীরা। কলেজে পড়ার সময় হিলারি একবার লাইফ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও স্থান পেয়েছিলেন। এর পরই ইতিহাস হিলারি। হয়েছেন সিনেটর, ফার্স্ট লেডি ও ওবামার প্রথম রাষ্ট্রপতি মেয়াদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এতক্ষণে ভোটে জয়ী হলে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে রিপাবলিকান প্রার্থীর রাজনীতিতে কোনো হাতেখড়ি নেই। জন্মেছেন নিউইয়র্কের রিয়েল এস্টেট টাইকুন ফ্রেডরিক ট্রাম্প পরিবারে। পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ ডোনাল্ডের ১৯৪৬ সালের ১৪ জুন কুইন্সে জন্ম। বাবা ফ্রেডরিক কুইন্স, স্টাটান আইল্যান্ড আর ব্রুকলিন এলাকায় সাধারণ মধ্যবিত্তদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট বানাতেন। অভিবাসীবিরোধী ইমেজ গড়ে তোলা ট্রাম্পের মা একজন স্কটিশ বংশোদ্ভূত; ছুটিতে নিউইয়র্ক বেড়াতে এসে ফ্রেডরিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তার। ধনীর ঘরে জন্ম নিলেও ছোটবেলায় বাবার প্রতিষ্ঠানে সর্বনিম্নস্তরে কাজ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন ডোনাল্ড। ছোটবেলা থেকেই পরিচিতি পান উদ্যমী আর আগ্রাসী হিসেবে। স্কুলে বেয়াড়াপনার ধারাবাহিক অভিযোগের মধ্যে ১৩ বছর বয়সে তাকে পাঠানো হয় সামরিক একাডেমিতে। এরপর নিজে বনে যান পুরোদস্তুর সফল ব্যবসায়ী। রিপাবলিকান দলের বড় অর্থদাতা। সেই অর্থদাতা থেকেই তিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন। রিপাবলিকান দলের ১৭ জন প্রার্থীকে পরাজিত করে প্রার্থিতা ছিনিয়ে নেন। পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ না হয়েও যদি আজ তিনি নির্বাচিত হন তবে এটা হবে অন্যরকম ইতিহাস।

সর্বশেষ খবর