বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

আমার প্রথম আবৃত্তি সুকান্তের কবিতা

সমরেশ মজুমদার

আমার প্রথম আবৃত্তি সুকান্তের কবিতা

আমি প্রথম গোটা কবিতা  মুখস্থ করেছিলাম ছয় বছর বয়সে। তখন আমি জলপাইগুড়ির জিলা স্কুলে ভর্তি হয়েছি। পুজো বা গরমের ছুটি বটেই, বড়দিনের ছোট্ট ছুটিতেও শহর ছেড়ে চা-বাগানে বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে থাকি। কিন্তু ওই বয়সেই সতী মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। রোগা, খাটো, আধময়লা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, ঘন ঘন নস্যি নেওয়া মানুষটির নেশা ছিল কখনো ঘরের খেয়ে, কখনো না খেয়ে, বনের মোষ তাড়ানো। স্থানীয় জুনিয়র স্কুলের শিক্ষক সতী মাস্টারমশাইয়ের ধ্যানজ্ঞান ছিল শিশুবালকদের মনের অন্ধকার দূর করা। যেখানে একদা ভবানী মাস্টারমশাইয়ের পাঠশালা ছিল, যেখানে দুর্গাপূজা হয়, স্টেজ বেঁধে নাটক করান সতী মাস্টারমশাই তারই সামনে। আর এসব যখন কিছুই থাকে না, তখন তিনি আমাদের মতো কয়েকজনকে নিয়ে মাঠের ওপর বসে গল্প বলতেন, ‘এই পৃথিবীটা বিশাল। তাকে ভাগ করা হয়েছে কয়েকটা মহাদেশে। সেই মহাদেশে কত দেশ। তা হলে বুঝতে পারছ সেই সব দেশে কত মানুষ থাকে। আমরাও আছি। এক দেশের মানুষ অন্য দেশের ভাষা বুঝি না, আমরা ভাত-ডাল-মাছ খাই, বেশির ভাগই তা না-খেয়ে অন্য খাবার খায়। কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যে খুব মিল আছে। সবাই আনন্দ হলে হাসে, দুঃখ পেলে কাঁদে। পৃথিবীর সব মা তার সন্তানকে আগলে রাখে, দ্যাখে যাতে তার কোনো কষ্ট না হয়। আমাদের বুকের ভিতর যে হূদয়, তা পৃথিবীর সব মানুষের একই রকম আছে। এই মানুষদের মাত্র দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। এক. যাদের সামর্থ্য আছে, দুই. যাদের নেই।’ আমরা জুলজুল করে দেখতাম আর কান খাড়া করে শুনতাম, একজন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘সামর্থ্য মানে কী?’ ‘সামর্থ্য হলো যাদের অর্থ আছে, ক্ষমতা আছে। যে কোনো সমস্যা তারা তাই সমাধান করে ফেলে সহজে। যাদের নেই তারা অসহায় হয়ে পড়ে থাকে। শুনলে তোমরা অবাক হবে পৃথিবীর দশ ভাগ মানুষের মধ্যে সাড়ে নয় ভাগ মানুষ অসহায়, তাদের কিছু নেই।’ ‘কেন নেই? ওরা কি কাজকর্ম করে না?’ কেউ সরল প্রশ্ন করেছিল। অবাক চোখে তাকিয়েছিলেন সতী মাস্টার, প্রশ্ন যে করেছিল তার মুখের দিকে। তারপর হেসে বলেছিলেন, ‘খুব ভালো প্রশ্ন। এর উত্তরটা যেভাবে দেওয়া উচিত তা দিলে তোমরা বুঝবে না। তবু বলি, অসহায় মানুষরাও চেষ্টা করে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে। কিন্তু ওই মুষ্টিমেয় অর্থবান তাদের দাবিয়ে রাখে। তাদের চেষ্টা সফল হতে দেয় না। কিন্তু এটা কি ঠিক?’ আমরা সবাই একসঙ্গে চেঁচাতাম, ‘না, ঠিক না।’

মাথা নাড়তেন তিনি, ‘এই জন্য আমরা চাই পৃথিবীর সব মানুষ একশ্রেণিতে থাকুক। কেউ খাবার নষ্ট করবে, আর বহু মানুষ খাবার পাবে না, এ যেন না হয়। এই পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। আমি একটা কবিতা আবৃত্তি করছি, তোমরা মন দিয়ে শোনো।’ সতী মাস্টারমশাই সোজা হয়ে বসে গলা খুলে আবৃত্তি করতে লাগলেন, ‘যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো আজ রাত্রে/তার মুখে খবর পেলাম।’ কিছুই বুঝিনি ওই বয়সে। কিন্তু ওর বলার ধরনে এবং কোনো কোনো শব্দে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। পরপর তিন দিন শুনেই কবিতাটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। একদিন আমি সতী মাস্টারমশাইকে নকল করে আবৃত্তি করলাম গোটা কবিতা। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি আনন্দে। ওর বুকের কাছে আসতেই আমি নস্যির গন্ধ পেলাম। স্বীকার করছি, সেই মুহূর্তে গন্ধটা আমার ভালো লাগেনি। কিন্তু যত দিন গিয়েছে, আজও ওই গন্ধের স্মৃতি অদ্ভুত ভালো লাগা তৈরি করে চোখ বন্ধ করলেই।

সতী মাস্টারমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কবিতাটা কার লেখা জানিস?’

মাথা নেড়ে নিঃশব্দে না বললাম।

‘কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। অসহায়, নির্যাতিত মানুষের কথা ওঁর কবিতায় বলেছেন।’

জীবনানন্দ দূরের কথা, রবীন্দ্রনাথ নয়, আমার প্রথম আবৃত্তি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা, যা সম্ভব হয়েছিল সতী মাস্টারমশাইয়ের জন্যই।

এরপরে প্রতি বছর যখনই চা-বাগানে গিয়েছি ততবারই মানুষটার কাছে ছুটেছি। যখন কিশোরবেলা তখন জেনেছি কার্ল মার্কসের কথা, গোর্কির ‘মা’ পড়েছি। স্বাধীনতার আগে পরে এদেশে কিছু মানুষ ছিলেন, যারা কমিউনিজমে আস্থা রাখতেন এবং নিজের বা পরিবারের কথা না ভেবে মানুষের জন্য কাজ করতেন শূন্য হাত সত্ত্বেও।

সেসব মানুষ কোথায় হারিয়ে গেলেন। আজকের কমিউনিস্টদের দেখে বারবার সতী মাস্টারমশাইয়ের কথা মনে পড়ে। শুধু সুকান্ত নয়, গণনাট্যের গান থেকে রবীন্দ্রনাথ তার কাছ থেকেই আমার জানা। কলকাতায় পড়তে এলাম। ছুটিতে যেতেই বললেন, “একটা পত্রিকা বের করব। নাম দিয়েছি ‘পাবক’। পাবক মানে আগুন। কিন্তু জলপাইগুড়িতে ভালো ছাপা হয় না। তোমাকে দায়িত্ব নিয়ে কলকাতা থেকে প্রকাশ করতে হবে। ৬০ পাতার কাগজ ছাপতে ওখানে কত খরচ তা ফিরে গিয়েই জানাবে।”

ফিরে এসে খোঁজ করতে করতে বিখ্যাত প্রকাশক প্রসূন বসুকে পেয়ে গেলাম। তিনি বাজেট করে দিলে সতী মাস্টারমশাই ওই টাকা পাঠিয়ে দিলেন। একদম নভিস আমি প্রসূন বসুর সাহায্যে কাগজ ছেপে ওর কাছে পৌঁছে দিতেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। অত আনন্দিত হতে ওকে দেখিনি কখনো। শেষের দিকে যোগাযোগ কমে এসেছিল। উনি চলে গিয়েছিলেন ময়নাগুড়িতে। শুনেছিলাম আমাদের যেভাবে শিক্ষিত করতে চেষ্টা করেছিলেন, ওখানে গিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে সেই চেষ্টাই করে গিয়েছেন। ঘামে-ভেজা পাঞ্জাবিতে যে নস্যির গন্ধ ছিল তার আকর্ষণ একটুও কমেনি, মানুষটির চলে যাওয়ার পরেও।

সর্বশেষ খবর