শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৪২

সিগারেটের শেষাংশে শুরু খুনের তদন্ত

মির্জা মেহেদী তমাল

সিগারেটের শেষাংশে শুরু খুনের তদন্ত

ছোট একটি রুম। সিলিংয়ের মাঝ বরাবর থেকে একটি মোটা বৈদ্যুতিক তার নিচে নেমে এসেছে। ২০০ পাওয়ারের বাল্ব ঝুলছে। বাল্বের ওপর একটি শেড। তার নিচে একটি চেয়ার। তাতে বসা এক যুবক। আলোর পুরোটাই পড়ছে যুবকটির ওপর। দর দর করে ঘামছিল। দুই হাতে হ্যান্ডকাফ। চোখ বাঁধা। যুবকটির উল্টো দিকের চেয়ারটায় পুলিশের এক কর্মকর্তা। পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন আরও দুই পুলিশ সদস্য। ‘বল সত্য কথা। নইলে তোর আজ খবর আছে।’ চেয়ারে বসা কর্মকর্তাটি যুবকটির উদ্দেশে বলছেন। ‘স্যার, আমি কিছু জানি না। আমারে কেন ধইরা আনছেন। আমারে এক গ্লাস পানি দেন’—যুবকটি বলে। পুলিশ কর্মকর্তা এবার বলে, ‘তোকে সব দিব। পানি, চা, বিস্কুট। সব। কিন্তু সত্য বলবি।’ পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে যুবকটির চোখ খুলে দেওয়া হয়। আরও একটি খালি চেয়ার যুবকটির পাশে এনে রাখা হয়। ফাঁকা চেয়ারে এক গ্লাস পানি, চা আর বিস্কুট। পুলিশ কর্মকর্তার হাতেও এক কাপ চা। তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন, আর জেরা করছেন। ‘নে চা খা। তোকে ভালোবেসে বিস্কুটও দিলাম। চায়ের সঙ্গে চুবিয়ে চুবিয়ে খেয়ে নে। কিন্তু সত্য তোকে বলতেই হবে। আর যদি সত্য না বলিস, আমি চলে যাব। আমার পেছনে যারা দাঁড়িয়ে আছে, ওরা চলে আসবে সামনে। তখন কিন্তু তোকেই ওরা বিস্কুট বানিয়ে চায়ের মধ্যে ডুবিয়ে রাখবে। আর জানিস তো, তখন তোর অবস্থা কী হবে? এই দেখ আমার দিকে।’ যুবকটি মাথা উঁচু করে তাকায় পুলিশ কর্মকর্তার দিকে। পুলিশ কর্মকর্তাটি চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে যখন মুখে দিতে যাবেন, তখনই বিস্কুটটির ভেজা অংশ ভেঙে নিচে পড়ে যায়। তার হাতে থাকে অর্ধেক বিস্কুট। অর্ধেক বিস্কুট যুবকটিকে দেখিয়ে পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, বুঝেছিস কিছু? তোর অবস্থাও হবে এই বিস্কুটের মতো। এখন বল, তুই বিস্কুট খাবি নাকি, বিস্কুট হবি? তোর ওপর নির্ভর করে’ পুলিশ কর্মকর্তার এমন কথা শুনে কেঁপে ওঠে যুবকটি। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। বলতে থাকে, ‘স্যার কমু, সব কমু। আমারে কিছু কইরেন না।’ খুলনার লবণচরা থানার হযরত বুড়ো মৌলভী (রহ.) দরগা এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ ইলিয়াস চৌধুরী (৭০) এবং তার মেয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা পারভীন সুলতানা (২৫) খুনের ঘটনায় গ্রেফতার অন্যতম আসামি লিটনের কাছ থেকে পুলিশ এভাবেই নানা কৌশলে তথ্য আদায় করে। ২০১৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে ‘ঢাকাইয়া হাউস’ বাড়ির সেপটিক ট্যাংকি থেকে বাবা-মেয়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ক্লু লেস এই খুনের ঘটনাটি ডাকাতির ঘটনা বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু পুলিশ ওই ঘরে পাওয়া কয়েকটি সিগারেটের শেষাংশ আলামত হিসেবে খুঁজে পায়। সিগারেটের সেই শেষাংশ থেকেই পুলিশ তদন্ত শুরু করে। পরবর্তীতে সেই সিগারেটের সূত্র ধরেই খুনিকে শনাক্ত করে। খুনের রহস্য উদঘাটন হয়। পুলিশ জানতে পারে, এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। বখাটে কয়েক যুবকের কাজ। অফিসগামী পারভীন সুলতানার ওড়না ধরে যখন টান দিয়েছিল বখাটে লিটন, তখন পারভীন তার হাতে থাকা টিফিন ক্যারিয়ার দিয়ে তাকে আঘাত করে। এই অপমানের প্রতিশোধ নিতেই বাবাকে হত্যার পর পারভীনকে ধর্ষণের পর খুন করে। বাসা থেকে লুটে নিয়ে যায় মালামাল। চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এই বাবা-মেয়ে খুনের ঘটনায় জড়িত আরও দুই ব্যক্তি এখনো পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি। তবে তিনজন এখন জেলে রয়েছে। খুনের ঘটনার পর খুলনাসহ সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। পুলিশ ঘটনাস্থল দেখে অনুমান করে, ঘটনাটি ডাকাতির। কারণ ওই বাসার আলমারি ভেঙে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার। ডাকাতরাই এ সময় বাবাকে হত্যা ও মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করে বলে পুলিশ ধারণা করে। কিন্তু তদন্ত করতে যেয়ে পুলিশ খুঁজে পায় ভিন্ন ঘটনা। এটি ডাকাতির ঘটনা নয়, পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যা খুনিরা স্বীকার করে।

জোড়া হত্যা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা খুলনার নগরীর লবণচরা থানার এসআই কাজী বাবুল হোসেন জানান, বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে তথ্য নিয়ে ঘটনার চার দিন পর নগরীর বুড়ো মৌলভীর (রহ.) মাজার এলাকা থেকে মো. লিটনকে (২৮) গ্রেফতার করা হয়। সে ওই এলাকার আবুল কালামের ছেলে। এরপর থানায় রেখে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে সে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। পরে আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রদান করে।

জেরার মুখে লিটন জানায়, ‘পারভীনরে আমার ভালো লাগত। রাস্তায় দাঁড়ায়া থাকতাম। একদিন হের ওড়না ধইরা টান দিছিলাম। কিন্তু এতোগুলা মানুষের সামনে আমারে টিফিন ক্যারিয়ার দিয়া বাড়ি মারে। হেইদিনই আমি চিন্তা করছি, ওরে দুনিয়াতে রাখুম না। প্রতিশোধ নিতে আমার মাথা খারাপ হইয়া যায়। আমার চার বন্ধুরে নিয়া মোট পাঁচজন গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪টার দিকে মই দিয়ে দেয়াল টপকাই। ভিতরে ঢুইকাই দেখি ঘরের দরজা খোলা। আমরা ঢুইকা যাই। পারভীনের বাবা আছিল। সে আগায়া আসলে তারে গলা টিপা হত্যা করি। পাশের ঘর থিকা দৌড়াইয়া আসে পারভীন। তারে আটকায়া ফেলি। রুমে নিয়ে আমরা তার ইজ্জত নেই। পরে গলাটিপা খুন করি তারেও। রাত পর্যন্ত আছিলাম। কিন্তু দুইটা লাশ লুকামু কই? চিন্তা করতে থাকি। পরে দুজনের লাশ টাইনা নিয়া সেপটিক ট্যাংকির ভিতর ফালাইয়া দেই। পরে পাঁচজনই ওই বাসার দেয়াল টপকায়া বাইর হইয়া যাই। আমার লগেরগুলা ভাইগা গেলেও আমি যাই নাই। ভাইগা গেলে সন্দেহ আমসার উপর আইতে পারে। এই জন্যে ভাগি নাই।’ জবানবন্দিতে পরিকল্পনাকারী ও খুনিদের নাম বেরিয়ে এলেও পুলিশ লিটন, সাঈদ ও পিটিল ছাড়া বাকি দুজন শরিফুল ও পলাশকে গ্রেফতার করতে পারেনি। পুলিশ সূত্র জানায়, তদন্ত করতে যেয়ে খুনি শনাক্ত করাটা দুরূহ হয়ে উঠেছিল। ডাকাত দলের খোঁজখবর নিতে সোর্স নিয়োগ করা হয়। কিন্তু সোর্সরা ডাকাতদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে কিছুই পাচ্ছিল না। বিশ্বস্ত এক সোর্সকে সিগারেটের শেষাংশ উদ্ধারের কথা বলেন পুলিশ কর্মকর্তা। তাকে দেখিয়ে বলেন, দেখিস এই ব্র্যান্ডের সিগারেট কেউ খায় কিনা। যারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। সিগারেটের টুকরা দেখেই সেই সোর্সের চেহারার পরিবর্তন ঘটে। জানায়, স্যার এই সিগারেট তো একজনে খায়। আবার একটু চেক কইরা দেইখা জানামু।’ পুলিশ কর্মকর্তা তাকে তারাতারি খোঁজ নিতে বলে। বিকালেই সেই সোর্স জানায়, ‘স্যার, হ্যাঁ পাইছি’। অবশেষে উদ্ধার হওয়া সিগারেটের শেষাংশই হয়ে উঠল চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের তদন্তের শুরু। গ্রেফতার হয় খুনি লিটনসহ তিনজন।

সর্বশেষ খবর