বুধবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দফায় আটকে আছে ঐক্য

বিএনপি ১৫ গণফোরাম ৭ যুক্তফ্রন্টের ৭ দফা । আছে জামায়াত ইস্যুও

মাহমুদ আজহার

দফায় আটকে আছে ঐক্য

দফায় আটকে আছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্য। এর প্রধান উদ্যোক্তা বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি এরই মধ্যে ১৪ দফা প্রণয়ন করেছে। এসব দফা ধরেই দলটি ঐক্য গড়ে তুলতে চায়। সব ঠিকঠাক থাকলে কিছু ছাড়ও দেবে বিএনপি।

বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট পৃথকভাবে সাত দফা প্রণয়ন করেছে। তারাও চায় এই সাত দফার ভিত্তিতে ঐক্য। এ ছাড়া ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম সত দফা ঘোষণা করেছে। আবার গণফোরাম ও বিকল্প ধারা যৌথভাবে চার দফায় ঐক্য করেছে। সবাই নিজেদের দফার ভিত্তিতেই ঐক্য চায়।

ঐক্য প্রক্রিয়ার উদ্যোক্তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের দফা নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। যুক্তফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে নিজের দফাগুলো নিয়ে ড. কামাল হোসেন একাধিকবার বৈঠক করেছেন। দফাগুলো নিয়ে আবার ঘষামাঝাও চলছে। কার্যত, এখন দফায় আটকে আছে ঐক্য।

বিএনপি ছাড়া ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত অন্য দলগুলোর দফার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী ও স্বাধীনতাবিরোধী দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো অংশগ্রহণ থাকতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় জামায়াত থাকলে তিনি থাকবেন না। তবে জামায়াত এখন আর কোনো রাজনৈতিক দল নয়। তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে।’ বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঐক্য প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জামায়াতের উপস্থিতি বোঝা গেলেই তিনি সেখানে থাকবেন না।’

যুক্তফ্রন্টের প্রধান উদ্যোক্তা বিকল্প ধারা মহাসচিব মাহি বি চৌধুরী বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হলে বিএনপিকে পরিস্কার করতে হবে এ প্রক্রিয়ায় কোনোভাবেই জামায়াত নেই। আমাদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য করবেন, আবার অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটে জামায়াতকে ধরে রাখবেন তা হতে পারে না। এমনটা হলে অন্যরা থাকলেও বিকল্প ধারা থাকবে না।’ বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের দফাগুলো ঘেটে দেখা যায়, তাদের দফাগুলোর পাঁচটিতে অভিন্ন ঐক্য রয়েছে। এগুলো হলো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা। তফসিলের আগে বর্তমান সরকারকে সরে যাওয়া ও সংসদ ভেঙে দেওয়া। সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনের অন্তত সাত দিন আগে নামাতে হবে। এরপর আরও সাত দিন বা প্রয়োজনে তাদের আরও কিছুদিন রাখা যেতে পারে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।

বিএনপি সূত্রে জানায়, ঐক্য নিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি এরই মধ্যে ১৫ দফা প্রণয়ন করেছে। এসব দফা ধরেই যুক্তফ্রন্ট ও ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা বলছে দলটি। অভিন্ন পাঁচ দফার বাইরে তাদের দফাগুলোয় রয়েছে— বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী সব রাজনৈতিক দলের নিঃশর্ত মুক্তি, মিথ্যা মামলা ও সাজা প্রত্যাহার, তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত চলমান রাজনৈতিক মামলা স্থগিত ও নতুন করে মামলা না দেওয়া, পুরনো মামলায় কাউকে গ্রেফতার না দেখানো, নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অবসানকল্পে জাতীয় ঐকমত্য গঠন করা, রাষ্ট্রক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, দুর্নীতি প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার, সব নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা এবং সর্বনিম্ন আয়ের মানুষের মানবিক জীবন নিশ্চিত করে আয়ের বৈষম্যের অবসানকল্পে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণ করা। ড. কামালের নেতৃত্বাধীন গণফোরামের সাত দফায় সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘সংবিধান প্রাধান্য’-কে সমুন্নত করে রাষ্ট্র পরিচালনা করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার, কার্যকর গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ব্যাংকিং খাত সংস্কার, তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদসহ জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা, রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

যুক্তফ্রন্ট সূত্রে জানা যায়, সাত দফার ভিত্তিতে ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে তারা গত দুই দিন ধরে বৈঠক করছেন। গত সোমবার এ নিয়ে বৈঠক করেন যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্য আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ যুক্তফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। তবে তাদের সাত দফার শুরুতেই বলা হয়েছে, স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী দলের বাইরে যে কোনো দল মতের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বিএনপি ও গণফোরামের সঙ্গে পাঁচটি দাবিতে তাদের অভিন্নতাও রয়েছে। তবে ক্ষমতায় ভারসাম্য রক্ষার জন্য বড় দলের জন্য ১৫০টির বেশি আসন না দেওয়ার কথাও বলছেন যুক্তফ্রন্টের উদ্যোক্তারা। তবে তারা সাত দফা দু-এক দিনের মধ্যেই চূড়ান্ত করে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গণফোরাম ও বিএনপির সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা রাজনীতিতে ও দেশ শাসনে একটা গুণগত পরিবর্তন আনতে চাই। আমরা চাই, আগামী নির্বাচনের পর কোনো একক দলের কাছে যেন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না হয়। নির্বাচনের আগেই যদি আমরা সে বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারি তাহলে তো বড় কোনো দলের সঙ্গে জোট করে কোনো লাভ নেই। নির্বাচনের পর সেই বড় দল হলে তারা স্বেচ্ছাচারীভাবেই দেশ পরিচালনা করবে।’

এ দিকে বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে পৃথক ঐক্য প্রক্রিয়ার চার দফা ঘোষণা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সংকট, চরম দুর্নীতি, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপসহ সব অন্যায় অবিচার থেকে জনগণের সত্যিকারের মুক্তি ও দেশের শান্তি প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। যৌথ ঐক্য প্রক্রিয়ায় তারা আরও বলেন, শুধু ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন না করে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে স্বাধীনতাবিরোধী দল বাদে সব গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল ও শক্তি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সব শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বড় রাজনৈতিক ঐক্য গড়তে ছাড় দিতে বিএনপি প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, গ্রেটার ইউনিটি কখনোই হবে না, যদি না আমরা কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার করি। ওই সব ছাড় দিয়ে আমাদের আজকে একটা না একটা জায়গায় আসতে হবে। আমরা সেই চেষ্টাই করছি। গোটা দেশ এটাই চায়। অন্যান্য যারা আছেন, তারাও বোঝেন, এটা ছাড়া কোনো মুক্তি নেই।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর