শিরোনাম
শুক্রবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
দেখার কেউ নেই

দখল হয়ে যাচ্ছে ঢাকার মাঠগুলো

উত্তরার ৩ নম্বর মাঠ ফ্রেন্ডস ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে, গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের, বেহাল মিরপুর মাঠও

সাঈদুর রহমান রিমন

দখল হয়ে যাচ্ছে ঢাকার মাঠগুলো

উত্তরা ৩ নম্বর মাঠ এখন ফ্রেন্ডস ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে —বাংলাদেশ প্রতিদিন

কার্যকর তদারকি ও নজরদারির অভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে রাজধানীর মাঠগুলো। মাঠের জায়গা দখল করেই পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। বাণিজ্যিক ব্যবহারের কারণে অনেক মাঠের আয়তন সংকুচিত হয়ে পড়েছে। একশ্রেণির প্রভাবশালীর জবরদখলের কারণে মাঠের ওপর স্থানীয় বাসিন্দাদের কোনো অধিকার থাকছে না। নিয়ন্ত্রকদের অনুমতি ছাড়া মাঠে খেলার সুযোগ পাচ্ছে না কেউ। এমনকি খেলার মাঠ মেলা ও সভা-সমাবেশের জন্য ভাড়া দিয়ে বাণিজ্যিক ফায়দা তুলছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। মাঠ ও খোলা প্রান্তরের অভাবে তারুণ্য এখন চার দেয়ালের ড্রইংরুমে বন্দী থেকে ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে। রাজধানীর অধিকাংশ মাঠ এখন আর খেলার উপযোগী নেই। বহুবিধ বাণিজ্যিক তৎপরতায় বিপন্ন হয়ে অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে ঢাকার মাঠগুলো। কাগজে কলমে রাজধানীর উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের মাঠটি দেখভাল করার দায়িত্ব সেক্টর কল্যাণ সমিতির, কিন্তু এ মাঠ দখল করে ভাড়া দিয়ে টাকা তুলছে উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাব। এলাকার শিশু-কিশোরদের টাকা দিয়ে মাঠে খেলাধুলা করতে হয় অথচ রাজউক এ বিষয়ে কিছুই জানে না। রাজউকের এ মাঠ এখন ফ্রেন্ডস ক্লাবের জন্য সোনার ডিম পাড়া হাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে ৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতি বা বাসিন্দাদের কোনো অনুষ্ঠান করতে হলেও ফ্রেন্ডস ক্লাবকে ভাড়া দিয়ে তবেই মাঠ ব্যবহার করা সম্ভব হয়। কল্যাণ সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট দেলোয়ার হোসেন ফারুক বলেন, ‘৩ নম্বর সেক্টরের অ্যালোটিদের অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, এ মাঠে তারা ঢুকতে পারছেন না। এমনকি তাদের সন্তানরাও খেলাধুলা করতে পারছে না। কল্যাণ সমিতির দফতর সম্পাদক নজরুল ইসলাম ভূইয়া মাহবুব জানান, রাজউকের মাঠটি দেখভালসহ যাবতীয় দায়দায়িত্ব ৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির হলেও বাস্তবে কল্যাণ সমিতির নিয়ন্ত্রণে নেই এ মাঠ। সেখানে ফ্রেন্ডস ক্লাবের খবরদারিত্বেই চলে মাঠটি। মাঠ উন্নয়নের নানা পরিকল্পনা নিয়েও কল্যাণ সমিতি বার বার ফ্রেন্ডস ক্লাবের বাধার মুখে পড়েছে। অর্থের বিনিময়ে মাঠ ভাড়া দেওয়াসহ সরকারি মাঠটি নিজেদের দখলে রাখার ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি ফ্রেন্ডস ক্লাব কর্তৃপক্ষ। রাজউকের একজন কর্মকর্তা জানান, এ মাঠটি রাজউকের সম্পদ। ৩ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দারা এ মাঠ ব্যবহার করবেন, যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করবেন। কিন্তু মাঠটি তো কাউকে নিজস্ব সম্পত্তির মতো ব্যবহার বা ভাড়া দেওয়ার জন্য দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, শিগগিরই মাঠটি অবৈধ দখলমুক্ত করে তা সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হবে।

গতকাল সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, উত্তরা মডেল টাউনে সরকারি জায়গায় রাজউকের গড়ে তোলা খেলার মাঠকে পুঁজি করেই চলছে ক্লাবের বাণিজ্য। সেখানে গেট বানিয়ে তালা লাগিয়ে বসানো হয়েছে নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী। মাঠে ঢুকতে চাইলেই মোটা অঙ্কের টাকায় সদস্য অন্তর্ভুক্ত হতে হয়, মাসে মাসে পরিশোধ করতে হয় দেড় হাজার টাকা ফি। টাকায় কেনা সদস্যপদ ছাড়া এলাকার শিশু, কিশোর, তরুণরা সে মাঠে প্রবেশ করারও সুযোগ পাচ্ছে না। তারা মাঠটি নানারকম বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করছেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অনেক বছর ধরেই উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের খেলার মাঠটি ‘ফ্রেন্ডস ক্লাবের’ একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রাজউকের এ মাঠের জায়গা দখল করেই গড়ে তোলা হয়েছে ফ্রেন্ডস ক্লাবের আলিশান পাঁচ তলা ভবন। নিচতলায় ২১টি দোকান মোটা অঙ্কের টাকায় পজিশন আকারে বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। তিন তলায় ফ্রেন্ডস ক্লাব কনভেনশন সেন্টারসহ অন্যান্য তলাও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তারাই মাঠের চারপাশ ঘিরে নিরাপত্তা বেষ্টনী নিশ্চিত করে প্রবেশ গেট বানিয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।

এখন সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত এককালীন জমা দিয়ে সদস্যপদ নিয়ে মাসে মাসে দিতে হয় দেড় হাজার টাকা ফি। এই মাসিক ফি বকেয়া পড়লেও সদস্যপদ স্থগিত করে মাঠের প্রবেশাধিকার রহিত করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, অপেক্ষাকৃত বয়সী মানুষ সকাল ও সন্ধ্যয় হাঁটার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা টাকা দিয়ে সদস্যপদ পাওয়ারও যেমন সুযোগ পাচ্ছেন না, তেমনি চারপাশের ব্যস্ততম রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোরও সাহস পান না। কিন্তু এসব অভিযোগকে ডাহা মিথ্যা বলে দাবি করেছেন ফ্রেন্ডস ক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদ। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘১৯৮৬ সাল থেকে ফ্রেন্ডস ক্লাব অত্যন্ত শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে মাঠটির তদারকি ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছে। ভবঘুরে, পাগল, নেশাখোর ও জবরদখলমুক্ত রাখার জন্যই মাঠের চারদিকে নিরাপত্তা বেস্টনীসহ গেট তৈরি হয়েছে। তবে বিকালে সব শিশু-কিশোরই মাঠে ঢুকতে পারে বলে জানান তিনি।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করে, এলাকার যুবকদের খেলার সুযোগ নষ্ট করে, স্থানীয় সাধারণ মানুষকে বিনোদন থেকে বঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে সবাইকে ঘরবন্দী বানাচ্ছে ফ্রেন্ডস ক্লাব কর্তৃপক্ষ। এদিকে ফ্রেন্ডস ক্লাবের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন পুরনো সদস্য জানান, ক্লাবের পক্ষ থেকে বাছাই করে ফুটবল ও ক্রিকেট টিমের সদস্য হিসেবে ভর্তি করা হয়। তাদের কাছ থেকেই নির্ধারিত টাকা ভর্তি ফি ও মাসিক ফি আদায় করার নিয়ম রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারাই প্রশিক্ষণ ও খেলাধুলার সুযোগ পান। বাকি শিশু-কিশোররা মাঠে ঢুকে হাঁটাহাঁটি করতে পারলেও কোনোরকম খেলাধুলার সুযোগ পায় না। ইদানীং মাঠের ভিতরে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলার অভিযোগও করেছেন বাসিন্দারা। তারা বলেন, মাঠের কোণে ঘর তুলে, মাঠের সীমানাঘেঁষে নানা দোকান বসিয়ে বেহাল পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। অথচ সেখানে সেক্টর কল্যাণ সমিতি কোনো উদ্যোগ নিতে গেলেই ফ্রেন্ডস ক্লাব সরাসরি বাধা দেয়।

অভিন্ন অবস্থা গুলশান ইয়ুথ ক্লাব মাঠের : এদিকে গুলশান আবাসিক এলাকার সেন্ট্রাল পার্কসংলগ্ন বৃহত্তম মাঠটিও গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রাজউক ১৯৭৭ সালে মাঠটি উন্নয়নের পরপরই ইয়ুথ ক্লাব এ মাঠে দখলদারিত্ব কায়েম করে। তারা মাঠের মূল অবকাঠামো বিনষ্ট করে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো মাঠকে কয়েক খণ্ডে বিভক্ত করেছে। মাঠের পূর্ব-উত্তর কোণের একাংশজুড়ে নানারকম পাকা স্থাপনা নির্মাণ করে মাঠকে সংকুচিত করা হয়েছে। সেখানে নানারকম খেলনাসামগ্রী স্থাপনের মাধ্যমে বানানো হয়েছে শিশু কর্নার। মাঠের দক্ষিণ কোণে গড়ে তোলা হয়েছে ইয়ুথ ক্লাবের তিন তলা ভবন। পাশেই কিচেনরুম, আলাদা রেস্টরুমসহ ছোট-বড় বেশ কয়েকটি স্থাপনাও নির্মিত হয়েছে সেখানে। এ ব্যাপারে রাজউকের পরিকল্পনা-অনুমোদন কোনো কিছু নেওয়ার প্রয়োজনবোধও করেনি ইয়ুথ ক্লাব। পাশেই রাজউকের গুলশান সেন্ট্রাল পার্ক থাকার পরও কেন মাঠটির অবকাঠামো বিনষ্ট করে আলাদা চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করতে হয়েছে— সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই ইয়ুথ ক্লাবের। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাঠ, শিশু কর্নার ও ক্লাব ভবন ঘিরে উঁচু প্রাচীর নির্মাণের পর দুই পাশে দুটি গেট করা হয়েছে। সেখানে ক্লাবের নিজস্ব নিরাপত্তা সদস্যরা ২৪ ঘণ্টা পাহারায় থাকেন। এ মাঠের চারপাশে ৩ ফুট চওড়া যে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সে পথ ধরে হাঁটাচলা করতে পারেন বাসিন্দারা, তবে শিশু-কিশোররা ইচ্ছা করলেও মাঠে খেলাধুলা করতে পারে না। খেলাধুলা করতে হলে ক্লাব নির্ধারিত বিভিন্ন বিভাগে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় ভর্তি হতে হয়, মাসে মাসে দিতে হয় দেড় থেকে ২ হাজার টাকা ফি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বছরের বিভিন্ন সময় নানারকম বাণিজ্যিক কাজে মাঠ ভাড়া দিয়ে সে টাকাও হাতিয়ে নেয় ইয়ুথ ক্লাব। গুলশানে বরাদ্দপ্রাপ্ত বাসিন্দারাও কোনো অনুষ্ঠানের জন্য ইয়ুথ ক্লাবকে চাহিদামাফিক ভাড়া দিয়ে তবেই মাঠের অংশ ব্যবহার করতে পারেন।

মিরপুর সিটি ক্লাবের মাঠ আরও বেহাল : মিরপুর-১২/বি ব্লকের সরকারি মাঠকে পুঁজি করে মিরপুরের সিটি ক্লাব বহুমুখী বাণিজ্য ফেঁদে বসেছে। সংঘবদ্ধ একটি চক্র ঐতিহ্যবাহী এ ক্লাব পরিচালনার নামে মাঠের জায়গাকে বাণিজ্য কেন্দ্র বানিয়ে পজিশন আকারে কেনাবেচা চালাচ্ছে। ক্লাবের মাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে বাস-মিনিবাসের গ্যারেজ হিসেবে। আশপাশেই গড়ে উঠেছে ওয়ার্কশপ, ভ্রাম্যমাণ হকার্স মার্কেট। মাঠের ভিতরে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার রাখা হয়নি। সেখানে খেলাধুলায় আগ্রহী শিশু-কিশোরদের ঢুকতে হলেও প্রবেশ ফি দিয়েই ঢুকতে হয়। এ ছাড়া চাহিদামাফিক টাকা দিয়ে সদস্য হয়ে তবেই সীমিত কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। জানা গেছে, পল্লবীর বহুল আলোচিত মোল্লাহ্ পরিবারের এক প্রভাবশালী সদস্য এ ক্লাব পরিচালনা কমিটির নেতৃত্বলাভের পর থেকেই সবকিছু পাল্টে ফেলা হয়েছে। নিয়মিত সেখানে জুয়ার রমরমা বাণিজ্যও চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। মিরপুর ১২ নম্বর বি ব্লকে অবস্থিত অত্র এলাকার অন্যতম বড় খেলার মাঠটি দখল করেই সিটি ক্লাবের পক্ষ থেকে নিয়ম করা হয়, মাঠে ঢুকে এলাকার ছেলেদের খেলতে হলে তাদের চাহিদামাফিক টাকা দিতে হবে। খেলতে আসা শিশু-কিশোরদের জনপ্রতি ভর্তি ফি ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা আর প্রতি মাসে বেতন বাবদ দিতে হয় ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। মাঠটি নিয়ন্ত্রণের পর থেকে মাঠের তিন দিকেই গড়ে তোলা হয়েছে মার্কেট। এসব দোকানের পজিশন বরাদ্দ বাবদ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে লাখ লাখ টাকা। প্রতি মাসে দোকান ভাড়াই নেওয়া হয় ২০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত। মাঝে মাঝেই নানাবিধ বাণিজ্যিক কাজে দু-তিন দিনের জন্য ভাড়া দেওয়া হয় মাঠটি। ভুক্তভোগী বাসিন্দারা জানান, কিছু চিহ্নিত ব্যক্তি সিটি ক্লাবের নামে দখল করা মাঠের জায়গায় মার্কেট বানিয়ে, জুয়া চালিয়ে, গাড়ির গ্যারেজ তুলে ও ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি টাকা আয় করছেন।

সর্বশেষ খবর