শনিবার, ১১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

নব্য লীগারদের হাতে মার খাচ্ছেন ত্যাগীরা

ভুঁইফোড় সুবিধাবাদীরাই আওয়ামী লীগে দাপুটে

রফিকুল ইসলাম রনি

নব্য লীগারদের হাতে মার খাচ্ছেন ত্যাগীরা

ঘটনা এক : ‘আমি বৃদ্ধ মানুষ। এত বছর আওয়ামী লীগ করি, কখনো কেউ আমাকে মারধর করেনি। অথচ নতুন করে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তারা আমার গায়ে হাত তুলল। পুলিশের সামনে এ ঘটনা ঘটেছে।’ কথাগুলো বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার গোহাইল ইউনিয়নের প্রবীণ রাজনীতিক ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউসুফ আলীর। বিএনপি থেকে সম্প্রতি আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া এক নেতার আক্রমণে আহত ইউসুফ আলী সাংবাদিকদের এ কথা জানান। গত বৃহস্পতিবার গোহাইল          ইউনিয়নে গোহাইল ইসলামিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে ঘটনাটি ঘটে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আলী আতোয়ার তালুকদার ফজু ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হন। বৃহস্পতিবার গোহাইল ইসলামিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুনানি চলাকালে নব্য লীগার এই চেয়ারম্যানের হাতে মারধরের শিকার হন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রবীণ নেতা। 

ঘটনা দুই : ১৯৯৭ সালে উপজেলা জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন রুহুল আমিন। কিন্তু কখনো দলে সক্রিয় ছিলেন না তিনি। ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি সৌদি আরবে ছিলেন। সেখানে তিনি ট্যাক্সি চালান। ২০০৯ সালের পর তিনি বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে গোপনে সম্পৃক্ত হন। তিন বছর পর হঠাৎ আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। দলের অন্য নেতারা এর ঘোর বিরোধিতা করেন। অনেক তদবির করে অবশেষে ২০১৩ সালে সোনাগাজী আওয়ামী লীগের সদস্য হন রুহুল। ২০১৫ সালে হঠাৎ করে সোনাগাজী ছাবের পাইলট হাইস্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি মনোনীত হন। তখন থেকেই সোনাগাজীতে নানা অপকর্ম শুরু করেন রুহুল। গড়েন ক্যাডার বাহিনী। ২০১৬ সালে সোনাগাজী আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্বাচিত হন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে জেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় সোনাগাজী আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। এক সময়ে পেটের দায়ে ট্যাক্সিক্যাব চালালেও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে আসায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যান রুহুল আমিন। সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ঘটনায় প্রথম থেকেই অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ-উদ-দৌলার পাশাপাশি অভিযোগের তীর ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন ও মাদরাসা কমিটির সহ-সভাপতি (সদ্য বিলুপ্ত) রুহুল আমিনের দিকে। নুসরাত হত্যা মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে।  ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে এমন নব্য লীগারদের নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী নেতা-কর্মীরা নানা অপকর্মে জড়িয়ে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে বলে মনে করছেন শীর্ষনেতারা। এ পরিস্থিতিতে অন্য দল থেকে আসা নেতা-কর্মীদের তালিকা তৈরি করে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দলটি। আগামী ঈদের পর অ্যাকশনে যাবে আওয়ামী লীগ। এ জন্য আট বিভাগে আটটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় টিম সারা দেশে সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে দলকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি এই শুদ্ধি অভিযান চালাবেন। বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে মাঝি হয়েও নৌকা ডোবানোর সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী-এমপি-বড় বড় নেতাও রেহাই পাবেন না এই শুদ্ধি অভিযানে। ক্ষমতার মধু খেতে দলে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড, বহিরাগত এবং দখল-চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত নেতাদের চিহ্নিত করে সংগঠন পুনর্গঠনের সময় তাদের হটিয়ে জনপ্রিয় নেতাদের সংগঠনের মূল নেতৃত্বে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অনেকে বলেছেন, ক্ষমতার সুবিধা নিতে বিভিন্ন দল থেকে যোগদানকারীর সংখ্যা উদ্বেজনক হারে বাড়ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় আছে, এখানে হাইব্রিডদের অনুপ্রবেশ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, অনেকে আওয়ামী লীগের বদনাম করার জন্য, অপকর্ম করে টাকা কামানোর জন্য দলে ভিড়ছে। অনেকে আছে চেহারাটা পাল্টিয়ে নব্য আওয়ামী লীগার হয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করে আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলছে। যারা দীর্ঘ সময় ধরে রাজনীতি করে যাচ্ছে, তারা অনেক সময় হাইব্রিডদের কারণে অবহেলিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে দলীয় সভানেত্রী খুবই সিরিয়াস। দ্রুতই অ্যাকশনে যাওয়া হবে।’  এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষ্য করেছি যে, বিভিন্ন সময় বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেন্দ্র করে বিভিন্ন দল থেকে এসে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বা বিদ্রোহী প্রার্থীর সঙ্গে ভিড়েছেন। বিভিন্ন দল থেকে যারা এসেছেন, তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে দলীয় ফোরামে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।’ 

দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে সাংগঠনিক সফর শুরু করেছি। আজ চট্টগ্রামে বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলন। সংগঠনকে ঢেলে সাজানো, দলের ঐক্য দৃঢ় করাই আমাদের কাজ।’ হাইব্রিড অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশনা নিয়ে আমরা ঈদের পর মাঠে নামব।’  রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তৃণমূল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যারা নিবেদিতপ্রাণ বলে পরিচিত ছিলেন, দলের দুর্দিনে যারা ত্যাগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন, আজ তারাই নিপতিত হয়েছেন চরম দুর্দিনে। ক্ষমতাবান, সুবিধাভোগী আর স্বার্থবাজ নেতারা তাদের দূরে ঠেলে রেখেছেন। নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীরা দলে কোণঠাসা আর ভুঁইফোড় সুবিধাভোগীরা বিপুল দাপটে; অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতায় তারা পরিপুষ্ট। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ সাংগঠনিক জেলা কমিটিতেই এখন সুযোগসন্ধানীদের তৎপরতার কারণে নানা সমস্যায় জর্জরিত তৃণমূল আওয়ামী লীগ। উড়ে এসে জুড়ে বসা নেতাদের মধ্যে দলীয় আদর্শের ছিটেফোঁটাও নেই। ছলে-বলে-কৌশলে, কখনো মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে, কখনো চাটুকারিতা করে তারা দলীয় পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে না পারলে আওয়ামী লীগকে মাশুল দিতে হবে।

সর্বশেষ খবর