ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে ৩৭ জন বাংলাদেশিসহ অন্তত ৬৫ জন মারা গেছেন। তিউনিসিয়ার উপকূলে ডুবে যাওয়া নৌকায় মোট ৮১ জন যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ৫১ জন বাংলাদেশি, ৯ জন মরক্কো, ৩ জন মিসরীয় এবং চাদসহ আফ্রিকার অন্যান্য দেশের নাগরিকরা ছিলেন। স্থানীয় জেলেরা ১৪ জন বাংলাদেশিসহ মোট ১৬ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে। উদ্ধার হওয়া বাকি দুজনের একজন তিউনিসিয়া ও একজন মিসরের। উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা স্থানীয় রেডক্রস কর্মীদের কাছে নিহত ও উদ্ধার বাংলাদেশিদের এ সংখ্যা জানিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে সিলেট জেলার সাতজনের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, নৌকাডুবিতে নিহত ব্যক্তিরা লিবিয়া থেকে নৌকায় চড়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন। উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশি বেলাল আহমেদের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। ছয় মাস আগে তাদের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে তারা যান দুবাই। সঙ্গে ছিল আরও দুজন। সেখান থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। সেখান থেকে আরেকটি ফ্লাইটে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে। ত্রিপোলিতে আরও প্রায় ৮০ জন বাংলাদেশি তাদের সঙ্গে যোগ দেন। এরপর পশ্চিম লিবিয়ার কোনো এক জায়গায় তাদের তিন মাস আটকে রাখা হয়। বেলাল বলেন, আমার মনে হয়েছিল, আমি লিবিয়াতেই মারা যাব। আমাদের দিনে মাত্র একবার খাবার দেওয়া হতো। অনেক সময় তারও কম। ৮০ জন মানুষের জন্য সেখানে টয়লেট ছিল একটি। আমরা শৌচকর্ম পর্যন্ত করতে পারতাম না। আমরা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করতাম।’ পরে একদিন তাদের উত্তর-পশ্চিম লিবিয়া থেকে একটি বড় নৌকায় তোলা হয়। এরপর সাগরের মাঝে তাদের আরেকটি ছোট নৌকায় তোলা হয়। ঠাসাঠাসি করে তোলায় এই ছোট নৌকাটি সঙ্গে সঙ্গেই ডুবে যেতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে একজন একজন করে ডুবে যায় নৌকায় থাকা ব্যক্তিরা, হারিয়ে যেতে থাকে সাগরের নিচে। বেলাল বলেন, ‘আমরা সারারাত সাঁতার কেটে ভেসে থাকি। বেঁচে থাকার সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। একসময় তিউনিসিয়ার উপকূলে মাছ ধরতে থাকা জেলেরা আসে। আল্লাহ যেন আমাদের বাঁচাতে এই জেলে নৌকা পাঠালেন।’ রেড ক্রিসেন্টের কর্মকর্তা মনজি স্লিম বলেন, উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা বলেছেন, রাত থেকে ভোর পর্যন্ত অন্তত আট ঘণ্টা তারা সাগরের ঠা া পানিতে ভাসছিলেন। তিউনিসিয়ার জেলেরা তাদের দেখে উদ্ধার করে। যদি জেলেরা এদের দেখতে না পেত, এদের কেউই আসলে বাঁচত না এবং এই ঘটনার কথাও হয়তো আমরা জানতে পারতাম না। বেলাল বলেন, এক দালালের মাধ্যমে আমরা আজকের পরিস্থিতিতে এসেছি। সেই দালাল আমাকে বলেছিল, আমরা বেশ ভালো জীবনযাপন করতে পারব। আমরা তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু আমি নিশ্চিত, যত লোককে সে এভাবে পাঠায়, তাদের বেশির ভাগই মারা যায়।
বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা এখন তিউনিসিয়ার উপকূলীয় জারজিস শহরে হাসপাতালে রয়েছেন। বেঁচে যাওয়া মানুষদের সামনে এখন তিনটি পথ খোলা আছে। তারা হয় নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে, অথবা জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মাধ্যমে আশ্রয় চাইতে পারে। অথবা তিউনিসিয়াতেই তাদের ভাগ্য পরীক্ষা করতে পারে। অবশ্য বেলাল আহমেদের মতো বাংলাদেশিরা বলছেন, আমরা তো সবকিছু হারিয়েছি। আমার এখন কিছুই নেই। আমি এখন ইউরোপেই যেতে চাই, যাতে সেখানে গিয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারি।
ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে নৌকায় করে অবৈধভাবে ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার ঘটনা অনেক পুরনো। এর আগেও নৌকা ডুবে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এ বছরের প্রথম চার মাসে সেখানে নৌকা ডুবে ১৬৪ জন মারা গেছে বলে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার তথ্য। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্রও বেরিয়ে আসছে।
ইউরোপের রঙিন স্বপ্ন প্রাণ কেড়ে নিল শামীমের : মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, ইউরোপের রঙিন স্বপ্ন নিয়ে চার মাস আগে লিবিয়ায় পাড়ি জমান আহসান হাবীব শামীম (১৯)। সেখান থেকে দালালের মাধ্যমে ৩ দিন পায়ে হেঁটে চড়ে বসেন টলারে। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে কাক্সিক্ষত দেশ ইতালি যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিউনিসিয়া এসে নৌকাডুবিতে সেই স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটে। নিহতদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজন সিলেট ও একজন মৌলভীবাজারের। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের বাদেভুকশিমইল গ্রামের হাজী আবদুল খালেকের ছেলে শামীম তাদের একজন। সিলেট গোটাটিকর সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে এ বছর দাখিল পরীক্ষার্থী ছিলেন শামীম। শামীমের বড়ভাই আবু সাইদ জানান, সাত ভাই ও তিন বোনের মধ্যে শামীম সবার ছোট। স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে তিনি হাফিজিয়া পাস করে সিলেটে আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখান থেকে এবারের দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল তার। গত রমজান মাসে তিনি এলাকার মসজিদে তারাবির নামাজ পড়াতে আসেন। সে সময় তাকে ইউরোপে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে পরিবার। সেই প্রক্রিয়ায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে দালালের মাধ্যমে তাকে ও তার বড় ভাই সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদের শ্যালককে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে তারা তিন দিন আগে ইতালির উদ্দেশে রওনা হন আরেক দালালের মাধ্যমে। তারপর জানা গেল শামীম তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবিতে মারা গেছেন।
এদিকে শামীমের মৃত্যুর খবরে এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। পরিবারের সদস্যরা ভেঙে পড়েছেন কান্নায়। স্বপ্নের ইউরোপ যাত্রার এমন সলিল সমাধি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। আদরের ছোট ছেলেকে হারিয়ে দিশাহারা মা রাজনা বেগম। শামীমের মা রাজনা বেগম বলছিলেন, গত বৃহস্পতিবার সাহরির সময় ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। শামীম মায়ের থেকে দোয়া নিয়েছে। জানিয়েছিল দীর্ঘ পথ পায়ে হাঁটার পর এবার তারা ৮০ জনের মতো সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছাবে। এটাই তার ছেলের সঙ্গে শেষ কথা। কিন্তু ছেলে আর তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি, এসেছে তার মৃত্যু সংবাদ।