শুক্রবার, ২৪ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা
ফলাফল বিশ্লেষণ

মোদির জয়, বিরোধীদের ভরাডুবি যে কারণে

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

কয়েক মাস আগেই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়ের বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস। বিরোধী শিবিরের আশা ছিল, এই তিন রাজ্যে বিজেপির ফল ব্যাপক খারাপ হবে। কিন্তু তিন রাজ্যে কার্যত ২০১৪ সালের ফলের  চেয়ে খুব একটা হেরফের হয়নি। অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে বিহারে বিজেপি-জেডিইউ-আরএলএসপির জোট কার্যত বিরোধীদের সাফ করে দিয়েছে। ঝাড়খন্ডেও প্রায় একই অবস্থা। আগেও উত্তর-পূর্বে বিজেপির ফল ভালো ছিল। সেই প্রবণতা এবারও বজায় রয়েছে।

বিজেপি তথা এনডিএর এই বিরাট সাফল্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কারণ একাধিক। প্রথমত, অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করলে গোবলয়ে বিজেপির ভোটবাক্সে ব্যাপক ধসের ইঙ্গিত থাকলেও তা হয়নি। দ্বিতীয়ত, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে নিজেদের আসন ধরে রেখেছে বিজেপি এবং তাদের সহযোগী দলগুলো। গোবলয়ে যে সামান্য সংখ্যক আসন কমেছে,  সেই ক্ষতি মেরামত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, বিহারের মতো রাজ্যে। দক্ষিণ ভারতে বিজেপি কখনই শক্তিশালী ছিল না। তবু এবার কর্ণাটক, তেলেঙ্গানায় ভালো করতে চলেছে এনডিএ জোট। এসব কিছুর যোগফলেই মুখ থুবড়ে পড়েছে কংগ্রেসসহ অন্যান্য বিরোধী জোটগুলো। অন্যদিকে, উত্তরপ্রদেশ থেকেই লোকসভায় সবচেয়ে বেশি সদস্য নির্বাচিত হয়। তাই ভারতের রাজনীতিতে উত্তরপ্রদেশের দখল নিতে পারলেই মসৃণ হয় প্রধানমন্ত্রিত্বের পথ। ২০১৪ লোকসভাতেও উত্তরপ্রদেশ দুই হাত ভরে আশীর্বাদ করেছিল মোদি-শাহ জুটিকে। উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব হাতে নিয়ে এই রাজ্যে যে গেরুয়া ঝড় তুলেছিলেন অমিত শাহ, তাতেই সহজ হয়ে গিয়েছিল মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লড়াইটা। ৮০টি আসনের লড়াইতে রাজ্যকে কার্যত বিরোধীশূন্য করে ৭৩টি আসন তুলে নিয়েছিলেন তারা। ২০১৯-এও তাই বিশেষ নজর ছিল উত্তরপ্রদেশের দিকেই। শাসক এনডিএ হোক বা কংগ্রেস বা মায়া-মুলায়ম, উত্তরপ্রদেশের দখল নিতে তৎপরতা দেখিয়েছিল সব পক্ষই। কেন্দ্রে ও রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও রামমন্দির তৈরি করতে না পারা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,  গোরক্ষকদের তা ব, জিহাদ কোনো ইস্যুই হাতছাড়া করতে চায়নি বিরোধীরা। অন্যদিকে নজর ছিল জাতপাতের সমীকরণ দিয়ে  ভোটের বাক্সের হিসাব উল্টে দেওয়া। পরিস্থিতি যে খুব সহজ ছিল, তা নয়। এ রকম একটা জায়গা থেকেই কট্টর হিন্দুত্বের লাইনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গেরুয়া ব্রিগেড। ভারতজুড়ে যখন গোরক্ষকদের বাড়াবাড়ি নিয়ে সমাজের একটা অংশে প্রতিবাদের ঝড় উঠছে, তখন তারা পাশে দাঁড়িয়েছিল গোরক্ষকদেরই। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির  তৈরির দাবিতে অটল ছিল তারা, যা ফের জায়গা করে নিয়েছিল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও। এই হিন্দুত্বের লাইনই ফের দুই হাত তুলে আশীর্বাদ করল বিজেপিকে।

বিবিসির সাংবাদিক সৌতিক বিশ্বাসের মতে, প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্যারিশমা এই ফলাফলের মধ্য দিয়ে অটুট রইল। বিজেপির পক্ষে তিনিই যে ভোট টানেন সেটা আবারও প্রমাণ হলো। বিজেপিকে ভোট দেওয়া মানেই তাকে ভোট দেওয়া- মোদির এই মন্তব্য কার্যকর হয়েছে, তা ভোটের ফলাফলেই প্রমাণিত। দ্বিতীয়ত, সাংগঠনিক দক্ষতা, যোগাযোগের সব ধরনের আধুনিক প্রক্রিয়া ব্যবহারসহ বিভিন্নভাবে বিজেপি দল হিসেবে শক্তি অর্জন করেছে, তা এখন অতিক্রম করা যে খুবই কঠিন, যার প্রমাণ ভোটের প্রচারে মিলেছে। তিনি বলেন, ভোটের প্রচারে বিজেপি যেভাবে অত্যন্ত কৌশলীভাবে জাতীয়তাবাদ, উন্নয়ন এবং ধর্মীয় মেরুকরণ নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেছে, তার বিপরীতে বিরোধী দলগুলো কার্যকর বক্তব্য হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিজেপির শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে কংগ্রেসকে এখন নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে। এজন্য শত বছরের প্রাচীন দলটিকে এখন কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি আঞ্চলিক পর্যায়ে দক্ষ নেতা এবং তৃণমূলে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। শহর ও গ্রামে কর্মসংস্থানের যে সংকট, সেটা কখনই ভোটে জেতার জন্য শক্তিশালী বার্তা হতে পারে না, যেখানে মোদি ‘জাতীয়বাদের’ মতো ভাষা দিয়ে বাজিমাত করেছেন।

ভারতীয় গণমাধ্যমের ধারণা, কংগ্রেসের পরাজয়ের পেছনে রয়েছে বেশিমাত্রায় নেতিবাচক প্রচারণা। ক্ষমতায় এলে কী করবেন সেটার থেকেও রাহুল গান্ধীর প্রচারে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মোদি বিরোধিতা। অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো ক্ষেত্রে উন্নয়ন করতে কংগ্রেসের রোড ম্যাপ কারও কাছেই স্পষ্ট হয়নি। বরং মোদি সরকারকে হটাতে হবে, এটাই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু তাকে সরিয়ে বিকল্প কে আসবেন এবং তারা দেশবাসীকে কী দেবেন, তার কোনো রূপরেখা তৈরি হয়নি। ফলে মানুষের কাছে আস্থা অর্জন করতে পারেনি কংগ্রেস।

সর্বশেষ খবর