শিরোনাম
শনিবার, ১ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভালো নেই সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা

ক্ষমতা নেই, নেতা কর্মীরাও পাশে নেই

রফিকুল ইসলাম রনি

আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে দুর্যোগ ব্যবস্থানা ও ত্রাণমন্ত্রী ছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম। তিনি ছিলেন চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর ও দক্ষিণ) আসনের এমপি। ওই সময় তার নির্বাচনী এলাকায় তার ‘একান্ত লোক’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন মতলব উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ কুদ্দুস। এলাকার নিয়ন্ত্রণ অনেকটা তার হাতেই থাকত। প্রায়ই মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপাড়ার বাসায় দেখা মিলত তার। মায়া একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলের টিকিট পেলেও পরে তা ধরে রাখতে পারেননি। খেলাপি ঋণ নিয়ে জটিলতা থাকায় মায়ার আসনে নৌকার টিকিট তুলে দেওয়া হয় সাবেক ছাত্রনেতা নুরুল আমিন রুহুলকে। রুহুল এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর মায়াকে ত্যাগ করে রুহুলের দলে ভিড়ে গেলেন কুদ্দুস। কুদ্দুসের মতো অনেক নেতাই আর মায়ার আশপাশেও হাঁটেন না। মতলব উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ কুদ্দুস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া সাহেব দীর্ঘদিন এলাকায় আসেন না। তাই তার সঙ্গে যোগাযোগ কম। এখন বর্তমান এমপি নুরুল আমিন রুহুল ভাইয়ের সঙ্গেই আছি। তিনি যখনই এলাকায়    আসেন, তখন তার সঙ্গেই থাকি।’ ঢাকায় মায়া সাহেবের বাসায় আসা হয় কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, দীর্ঘদিন যাওয়া হয় না।’ দশম জাতীয় সংসদে আলোচিত-সমালোচিত এমপি ছিলেন আরিফ খান জয়। তিনি নেত্রকোনা-২ আসন থেকে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়েই যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। উপমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তার কয়েক ভাই ও কিছু নেতা-কর্মী মন্ত্রণালয় ও ক্রীড়াপাড়ায় দাপিয়ে বেড়ান। নির্বাচনী এলাকায়ও একচ্ছত্র দাপট। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি। এখন আর আগের মতো গাড়ির বহর কিংবা নেতা-কর্মীর দেখা মেলে না তার আশপাশে। এমনকি নির্বাচনী এলাকায়ও দেখা মেলা ভার। সাবেক ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম ও উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ই নন, এমন অনেক এমপি-মন্ত্রীর পাশে এখন কেউ নেই। তাদের কাছে ‘ক্ষমতা’ নেই, তো নেতা-কর্মীও নেই। শুধু পাশে নেই তা নয়, সদ্য সাবেক হওয়া অনেক এমপি-মন্ত্রীই এখন ভালো নেই। নির্বাচনী এলাকায় তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। বর্তমান এমপির লোকজন ছাড়াও উপজেলা-জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের রোষানলে পড়েছেন তারা। তৃণমূলে সম্মেলনের ডামাডোল বেজে ওঠায় ‘সাবেক এমপি ঠেকাও’ মিশনে বেকায়দায় পড়েছেন তারা। আবার এমপি থাকা অবস্থায় কারও কারও অতিবাড়াবাড়ির কারণেই ‘পরিণতি’ ভোগ করছেন বলে মনে করেন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। সাবেক এমপি-মন্ত্রী ছাড়াও দলের হেভিওয়েট নেতারাও এ তালিকায় রয়েছেন। ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে ‘প্রিয় নেতা’ও বদল করেছেন নির্বাচনী এলাকার মানুষ। সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের ক্ষমতা বদলের সঙ্গে ‘প্রিয় ভাই, প্রিয় নেতা’ বদলে গেছে নেতা-কর্মীদের। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নীলফামারী-৩ (জলঢাকা) আসনে নৌকা নিয়ে এমপি হয়েছিলেন গোলাম মোস্তফা। একাদশ সংসদ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এ আসনে জাতীয় পার্টির রানা মোহাম্মদ সোহেলকে ছেড়ে দেওয়া হয়। জোটের কারণে মনোনয়নবঞ্চিত গোলাম মোস্তফার বিড়ম্বনার শেষ নেই। এমপিত্ব নেই, তাই তার কদরও নেই নিজ এলাকায়। গত পাঁচ মাসে দলীয় কোনো কর্মসূচিতে তাকে ডাকা হয়নি। সাবেক এই এমপি অভিযোগ করে বললেন, ‘গত পাঁচ বছর এমপি ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছিলেন কয়েকজন দলীয় নেতা। তারা দীর্ঘদিন দলের পদ-পদবি ব্যবহার করে নানা অপকর্ম করেন, আমি প্রতিবাদ করায় আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটান। এখন এমপিত্ব নেই, দলীয় কোনো কর্মসূচিতে আমাকে ডাকা হয় না। একটি দাওয়াতও পাই না।’ অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদ হোসেন রুবেল বলেন, ‘এমপি দুবার উপজেলা সভাপতি পদের জন্য ভোট করে হেরে গিয়ে আমাদের মানতে পারছেন না। তাই অভিযোগ করছেন।’

নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে দশম সংসদে নৌকা নিয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন সাবেক ছাত্রনেতা আবুল কালাম আজাদ। গত পাঁচ বছর সুনামের সঙ্গেই নির্বাচনী এলাকার মানুষের পাশে থেকে উন্নয়নকাজ করেছেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে এ আসনে দলের মনোনয়ন পান শহীদুল ইসলাম বকুল। সে সময় মনোনয়নবঞ্চিত আবুল কালাম আজাদ নৌকার পক্ষে কাজ করে বকুলকে এমপি নির্বাচিত হতে সহায়তা করেন। এমপি নির্বাচিত হয়েই সাবেক এমপিকে ‘সাইজ’ করার মিশনে নেমে পড়েন বর্তমান এমপি। সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ অভিযোগ করেন, ‘১৯৭৫-এর পর কেউ আওয়ামী লীগের নাম মুখে নেয়নি। ১/১১ সময়ও অনেকে অনেক রকম ছিলেন। এখন তারাই বড় বড় আওয়ামী লীগ। উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজের ভাইকে উপজেলা চেয়ারম্যান বানিয়েছেন বর্তমান এমপি। তিনি এলাকায় “এমপি লীগ” তৈরি করছেন। দলীয় কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিতে গেলে এমপির লোকজন মঞ্চ ভেঙে দেন। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে মঞ্চে রাখেন না। জেলার সিনিয়র সহসভাপতি এমনকি সাবেক এমপি হিসেবেও কোনো দাওয়াত পাই না।’

একাদশ সংসদে শরীয়তপুর-১ আসনে মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক। এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন দলের কার্যনির্বাহী সদস্য ইকবাল হোসেন অপু। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে এ দুই নেতার মধ্যে ঠা া লড়াই ছিল দীর্ঘদিন। মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর আর এলাকায় পা রাখেননি সাবেক এমপি বি এম মোজাম্মেল হক। অবশ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি দলের সমন্বয় কমিটির অন্যতম নেতা ছিলেন। নির্বাচনী এলাকায় না যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে সাবেক এই এমপি বললেন, ‘সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই এলাকায় যাওয়া হয়নি।’ কবে নাগাদ যাবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এখনই যাওয়ার সময় হয়নি। নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার “প্রয়োজনীতা” বাড়–ক।’

জানা যায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত অংশগ্রহণ না করায় সহজ জয় পেয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন ১৪-দলীয় জোট। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ১৫৪ জন। আবার কেউ নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন। ‘সহজ’ জয়ের কারণে অনেক এমপি নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াত এবং নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। কেউ কেউ এলাকার দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছেন এমন অভিযোগেরও কমতি ছিল না। অনেক স্থানে এমপিদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন তৃণমূল নেতারা। এরপর কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই এমপিদের দলীয় মনোনয়নের বাইরে রাখা হয়। দেওয়া হয় নতুন প্রার্থী। অন্যদিকে চার মাস হলো যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের কর্মকাে ও খুশি হতে পারছেন না নির্বাচনী এলাকার দলীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ। নবনির্বাচিতরাও ওই কায়দায় রাজনীতি শুরু করেছেন। বিশেষ করে সাবেক এমপি ও এমপিপন্থি নেতা-কর্মীদের ওপর দেখাচ্ছেন ক্ষমতার প্রভাব; যা নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে শুরু হয়েছে অন্তঃকলহ। গত সংসদ নির্বাচনে মন্ত্রী-উপমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন হেভিওয়েট নেতাও ছিলেন।

সর্বশেষ খবর