সোমবার, ১৭ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

অবশেষে গ্রেফতার ওসি মোয়াজ্জেম

নিজস্ব প্রতিবেদক

অবশেষে গ্রেফতার ওসি মোয়াজ্জেম

ওসি মোয়াজ্জেম

নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে গ্রেফতার হলেন ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন। উচ্চ আদালত এলাকা থেকে গতকাল বেলা সাড়ে ৩টার দিকে তাকে গ্রেফতার করে শাহবাগ থানা পুলিশ। বিকালেই তাকে ফেনীর সোনাগাজী থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল থেকে ওই থানাতেই মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট পাঠানো হয়েছিল। জানা গেছে, ইন্সপেক্টর মোয়াজ্জেম পালিয়ে গেছেন বলে সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল। তবে ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন দ্রুতই গ্রেফতার হবেন এমন কথা পুলিশ ও সরকারের ঊর্ধ্বতনরা বলে আসছিলেন। থানায় অভিযোগ করতে আসা ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির সঙ্গে কথোপকথনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন ইন্সপেক্টর মোয়াজ্জেম। পিবিআইর এই প্রতিবেদন সাইবার ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হলে ২৭ মে পুলিশ কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতারে পরোয়ানা জারির আদেশ দেন বিচারক। একাধিক সূত্র বলছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশের পর বুধবার থেকে মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতারে জোর তৎপরতা চালায় পুলিশ। সর্বশেষ পুলিশ সদর দফতরের অপরাধ পর্যালোচনা সভায় এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। আসে পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কড়া নির্দেশনা। নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। বিভিন্ন ইউনিটের সঙ্গে মাঠে নামে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হয় ৯ থেকে ১১ জুন পর্যন্ত মোয়াজ্জেম হোসেন রাজধানীর কল্যাণপুরে তার এক খালার বাসায় অবস্থান করছিলেন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি কল্যাণপুর থেকে সটকে পড়েন। চলে যান কুমিল্লায়। নিজ বাসায় না থেকে কৌশলে চান্দিনায় এক পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় স্ত্রী রুমাকে নিয়ে অবস্থান নেন মোয়াজ্জেম। তবে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে তিনি ওই বাসা ছেড়ে দেন। এর আগেই তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করতে থাকেন তার এক আত্মীয় খায়রুল ও এক সময়ের গাড়িচালক জাফরের সঙ্গে। এই জাফরই আগাম জামিনের জন্য যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন আইনজীবী সালমা ইসলামের সঙ্গে। আইনজীবীর পরামর্শেই গতকাল সকালে আগাম জামিন নিতে কুমিল্লা থেকে সরাসরি ঢাকায় আসেন মোয়াজ্জেম হোসেন। নজরদারি এড়াতে তিনি মুখে দাড়ি রেখেছিলেন। পরনে ছিল স্যান্ডেল, প্যান্ট ও টি-শার্ট।

জানা গেছে, আগাম জামিনের আবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করে গতকালই শুনানির চেষ্টা করেন অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম। তবে আবেদনটি গ্রহণ করে বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ আজ শুনানির দিন ধার্য করেন। এই খবরে মুষড়ে পড়েন ওসি মোয়াজ্জেম। ওতপেতে থাকা ডিবির একটি দল তাকে গ্রেফতার করতে আইনজীবীর চেম্বারের বাইরে অবস্থান করছিলেন। তবে এরই মধ্যে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসানের নেতৃত্বে একটি দল সাদা পোশাকে ওই চেম্বার থেকেই গ্রেফতার করেন মোয়াজ্জেমকে।

কিন্তু রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার সাংবাদিকদের বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মোয়াজ্জেমকে হাই কোর্টের কদম ফোয়ারা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে গ্রেফতারের বিষয়টি সোনাগাজী থানাকে জানানো হয়েছে। যেহেতু ওই থানায় গ্রেফতারের পরোয়ানা আছে, সে জন্য তাদের কাছে তাকে হস্তান্তর করা হবে। এরপর তারা ঠিক করবেন কোন আদালতে ওঠাবেন।

সূত্রে জানা গেছে, হাই কোর্ট থেকে বের হতে পারলে কিংবা আগাম জামিন পেলে দূরসম্পর্কের আত্মীয় খায়রুলের বাসায় রাতযাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মোয়াজ্জেম। তবে খায়রুল ইসলাম দাবি করেন, জামিনের জন্য মোয়াজ্জেম এসেছিলেন আদালতে। পরে শুনানির তারিখ পিছিয়ে কাল (আজ) সোমবার করা হলে পুলিশ মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার করে বিকাল ৪টায়। মোয়াজ্জেম হাই কোর্টে এসেছিলেন সকাল সাড়ে ১০টায়। মোয়াজ্জেম আজ আদালতে আসবেন এ বিষয়টি তিনি আইনজীবী সালমা ইসলামের কাছ থেকে জেনেছেন।

মামলার তদবিরকারী মো. জাফর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি তিন বছর আগে ছয়-সাত মাস স্যারের মোয়াজ্জেম) গাড়ি চালাতাম। এরপর আমি সৌদি আরব চলে যাই। দেড় বছর আগে দেশে ফিরে এলে স্যারের সঙ্গে আবার যোগাযোগ হয়। ২৭ মে স্যারকে আমি আমার গাড়িতে করে ঢাকায় নিয়ে এলে স্যারের পরামর্শে আগাম জামিনের আবেদন করি। আজ স্যার অন্যভাবে ঢাকায় এসেছেন। তবে আইনজীবীর সঙ্গে আমার বিভিন্ন সময় যোগাযোগ হতো। আইনজীবীর পরামর্শেই স্যার আজকে ঢাকায় এসেছিলেন।’

মোয়াজ্জেম হোসেনের আইনজীবী সালমা ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আজ (গতকাল) বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাই কোর্ট বেঞ্চে ওসি মোয়াজ্জেমের আগাম জামিনের একটি আবেদন কার্যতালিকায় আনার জন্য উপস্থাপন করেছিলাম। তখন আদালত বলেছিল আগামীকাল বিষয়টি আদালতের কার্যতালিকায় থাকবে। তবে এরপর তিনি যেহেতু গ্রেফতার হয়েছেন, সেহেতু আগাম জামিনের আবেদনটি আগামীকাল শুনানির আর সুযোগ নেই।’ তবে ওসি মোয়াজ্জেমের সঙ্গে তার দেখা হয়নি বলে দাবি করেন আইনজীবী সালমা ইসলাম।

প্রসঙ্গত, মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানির অভিযোগে নুসরাতের মা বাদী হয়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা করলে পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজকে গ্রেফতার করে। এ মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাত ও তার পরিবারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে অধ্যক্ষের লোকজন। এতে ব্যর্থ হয়ে ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে কৌশলে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য আসামিরা চাপ দেয়। পরে পরিকল্পিতভাবে নুসরাতকে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে নুসরাত অগ্নিদগ্ধ হন। তাকে প্রথমে ফেনী সদর হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল রাতে নুসরাত মারা যান।

সর্বশেষ খবর