বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

বন্ড মাফিয়ারা বছরে লুটছে লাখ কোটি টাকা, সিংহভাগই পাচার

লুটেরা চক্রের মূল হোতা আবুল ও পর্বত সিন্ডিকেট

সাঈদুর রহমান রিমন

বন্ড মাফিয়ারা বছরে লুটছে লাখ কোটি টাকা, সিংহভাগই পাচার

সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা আবুল হোসেন

বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার আড়ালে সংঘবদ্ধ চক্রের প্রতিবছর এক লাখ কোটি টাকা লুটপাট সাধনের অভিযোগ উঠেছে। লুটের সিংহভাগ অর্থই পাচার হচ্ছে বিদেশে। আবুল হোসেন-ফজলুর রহমান পর্বতের নেতৃত্বে বন্ড লুটেরা মাফিয়া গ্রুপের অপরাধ-অপকর্ম কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। তারাই গোটা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প খাতকে জিম্মি করে সব সুবিধা চুষে নিচ্ছেন, লুটে নিচ্ছেন পুঁজির টাকা। চিহ্নিত এ মাফিয়া চক্রের বেশুমার প্রভাবের কাছে কাস্টমস, পুলিশ, ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে শিল্প-বাণিজ্য খাতের নীতিনির্ধারকরা পর্যন্ত ধরাশায়ী হয়ে পড়েছে। তাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করতেও সাহস পাচ্ছে না কেউ। বন্ড মাফিয়া চক্রের বিরুদ্ধে অভিযানে নামা কাস্টমস কর্মকর্তারা পর্যন্ত চরম হামলা ও মারধরের শিকার হয়েছেন। কাস্টমস কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বেধড়ক পিটিয়ে রক্তাক্ত করেও তারা বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। বরং বন্ড অপব্যবহারবিরোধী অভিযানকারী কাস্টমস কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার মতো দাপটও দেখিয়েছে মাফিয়া চক্রটি। এভাবেই বছরের পর বছর অজ্ঞাত ক্ষমতার জোরে সবাইকে জিম্মি করে তারা যা ইচ্ছে তা-ই করে চলেছেন। এতে কাগজ, কাপড়, প্লাস্টিকসহ দেশীয় শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ধ্বংস হতে চলেছে গোটা শিল্প খাত, সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার। সবকিছুই চলছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। তারা দেখেও না দেখার ভান করে রাষ্ট্রীয় লুটপাটের বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বন্ড কমিশনার করেনটা কী তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ব্যবসায়ী মহলে।

রাজধানীর নয়াবাজারে বন্ডের অবৈধ পণ্য বিক্রি এবং এ চক্রের মূল হোতা আবুল হোসেন মার্কেটের কর্ণধার আবুল হোসেন ও বাংলাদেশ পেপার মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলুর রহমান পর্বতের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়ারও সাহস পান না কেউ। তাদের দিকে কড়া নজরে তাকানো কাস্টমস কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন আমলা পর্যন্ত কারও রেহাই মেলে না। বেজায় দাপুটে মাফিয়ারা ‘বৈরী কর্মকর্তাদের’ তালিকা তৈরি করে তাৎক্ষণিক বদলি, অপসারণ, শাস্তিমূলক পোস্টিং, বিভাগীয় তদন্তের নামে ধারাবাহিক হয়রানি চালানোর নানা স্পর্ধা দেখিয়ে থাকে। ফলে অজ্ঞাত আতঙ্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কাস্টমস বিভাগ, এমনকি শিল্প-বাণিজ্য খাতের ঊর্ধ্বতন আমলারা পর্যন্ত বন্ড মাফিয়াদের আজ্ঞাবহ থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

সব মিলিয়ে বাধাহীনভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভয়ঙ্কর লুটপাট চালিয়েও বন্ড মাফিয়ারা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ নিয়ে দেশের ব্যবসায়ী মহলে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ীরা অবিলম্বে বন্ড মাফিয়া আবুল-পর্বত গংদের ব্যাপারে দুদকের তৎপরতা দাবি করেছেন। তারা বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের সহায়-সম্পদের খোঁজ নিতে গেলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। রাতারাতি মাফিয়া সদস্যদের হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার বৈধ কোনো উৎস নেই। রাষ্ট্রীয় সুবিধা একচ্ছত্রভাবে লুটে নেওয়ার অবৈধ বাণিজ্যেই তারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছে। দেশে-বিদেশে তাদের সম্পদ-প্রাচুর্যের অভাব নেই। মাফিয়া চক্রের টাকা পাচার প্রক্রিয়ায় দেশের হুন্ডি বাণিজ্য সচল থাকারও অভিযোগ তুলেছেন ব্যবসায়ীরা।

মাফিয়া দৌরাত্ম্যে এনবিআরের উদ্যোগও বাধাগ্রস্ত : বন্ড সুবিধার অব্যাহত অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এনবিআর অতিসম্প্রতি কঠোর ভূমিকায় মাঠে নামলেও হঠাৎ করেই যেন তা থমকে দাঁড়িয়েছে। ঝিমিয়ে পড়েছে এনবিআরের বিশেষ অভিযান। বরং অভিযান চালানো একেক কর্মকর্তাকে একেকভাবে হয়রানির কবলে ফেলা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে পুরান ঢাকায় বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়ে আপসহীন ভূমিকায় থাকা কাস্টমস কর্মকর্তাকেও টিকে থাকতে দেওয়া হয়নি। মাফিয়া চক্র দোর্দ- দাপটে ওই কাস্টমস কর্মকর্তাকে হটিয়ে দিয়েছে। এমনকি তার অভিযানিক ক্ষমতাও অঘোষিতভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। হয়রানিমূলক এ শাস্তির ঘটনায় মাঠে থাকা কাস্টমসের অন্যান্য অভিযানিক কর্মকর্তার মধ্যেও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে দায়সারা গোছের রুটিন কাজের বাইরে উদ্যোমী উদ্যোগ নেওয়ার সাহস পর্যন্ত পাচ্ছেন না। ফলে এনবিআরের শুভ উদ্যোগও এখন রুটিন কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এসব কারণে বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত নানা পণ্য আমদানির বড় বড় চালান আবারও কালোবাজারে দেদার বিক্রি করে চলেছেন বন্ড লাইসেন্সধারীরা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কখনো চালান না দিয়ে, কখনো ভুয়া চালান দিয়ে, কখনোবা একই চালান একাধিকবার ব্যবহার করে বন্ড সুবিধায় আমদানিকৃত পণ্য অবৈধভাবে খোলাবাজারে ছাড়া হচ্ছে। বন্ড সুবিধা অপব্যবহারের মাধ্যমে তারা একদিকে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, অন্যদিকে দেশীয় শিল্প খাতকে অসম প্রতিযোগিতায় ফেলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানাগুলো পুনঃ রপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধায় পণ্য আমদানির সুযোগ পায়। এসব কাঁচামাল বা পণ্য সরকারনির্ধারিত গুদামে (বন্ডেড ওয়্যারহাউস) রক্ষিত থাকে। কিন্তু একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দেশে শুল্কমুক্ত পণ্য এনে অবৈধভাবে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। বন্ড সুবিধায় আনা কাপড়, প্লাস্টিক দ্রব্য, কাগজপণ্য, ডুপ্লেক্স বোর্ড, আর্ট কার্ড, কার্ড বোর্ড, বৈদ্যুতিক পাখা ইত্যাদি পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চিহ্নিত দুর্বৃত্ত চক্র। সাম্প্রতিক সময়ে এনবিআরের তদন্তে দেশি-বিদেশি ৩২৪টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৭৯০ কোটি টাকা পাচারের বিষয় চিহ্নিত হয়েছে। জানা যায়, এনবিআরের বিভিন্ন শাখা কর্মকর্তাকে নিয়ে গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক ও এনবিআরের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে বন্ড সুবিধাপ্রাপ্তদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। তদন্তকালে নির্দিষ্ট ঠিকানায় সরেজমিন গিয়ে বন্ড সুবিধাভোগী ৩২৪টি প্রতিষ্ঠানের কোনো হদিস পাননি। এসব প্রতিষ্ঠানের আওতায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা লুটপাট করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভারত, মালয়েশিয়া, চীন, ওমান, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, ভিয়েতনাম, ডেনমার্কসহ ২১টি দেশ থেকে পণ্য আমদানির নামে অর্থ পাচার করেছে। অর্থ পাচারকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রভাবশালী মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন বলেও এনবিআর তদন্তের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে নানা প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণের অভিযোগ উঠেছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর বন্ডের অপব্যবহারবিরোধী জোর তৎপরতায় মাঠে নামতেই ‘রাজস্ব লুটপাটের’ নানা কাহিনি বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। দেশের প্রভাবশালী মাফিয়া সিন্ডিকেটের দেশীয় শিল্প ধ্বংসের ‘দেশদ্রোহী’ কর্মকান্ডে র বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকায় নামে এনবিআর। কিন্তু মাফিয়া চক্রের নানামুখী দৌরাত্ম্যে এনবিআরের শুভ উদ্যোগও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে খুবই সতর্ক। এ নিয়ে নিয়মিত কাজ করছে শুল্ক গোয়েন্দা। চোরাচালান-অর্থ পাচারের আড়ালে বন্ডের অপব্যবহার ঠেকাতে আমরা সংকল্পবদ্ধ।’

সর্বশেষ খবর