সোমবার, ২২ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

হতাহত অধিকাংশই মানসিক রোগী

আরও একজনকে পিটিয়ে হত্যা, আহত ৩০

প্রতিদিন ডেস্ক

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে একজন নিহত ও দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজন নারী রয়েছেন। হতাহতদের বেশিরভাগই মানসিক ভারসাম্যহীন ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- মৌলভীবাজার : জেলার কমলগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক ব্যক্তি (৫০) নিহত হয়েছেন। শনিবার রাত ১০টার দিকে রহিমপুর ইউনিয়নের দেওড়াছড়া চা বাগানে এ ঘটনাটি ঘটে। দেওড়াছড়া চা বাগান পঞ্চায়েত সভাপতি সুবোধ কুর্মী জানান, দেওড়াছড়া চা বাগান এলাকায় স্থানীয় লোকজন সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখে অজ্ঞাত পরিচয়ের ওই ব্যক্তিকে আটক করে নাম পরিচয় জানতে চায়। এ সময় তার অসংলগ্ন কথাবার্তায় ছেলেধরা সন্দেহে শ্রমিকরা চা বাগান অফিসে নিয়ে আসেন। একপর্যায়ে শতাধিক শ্রমিক বিক্ষুব্ধ হয়ে অফিসে ঢুকে গণপিটুনি দেয়।

চা বাগানের মেডিকেল সুপারভাইজার গোপাল দেব তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাত ১২টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কমলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আরিফুর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, চা শ্রমিকরা ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয়। গুরুতর আহতাবস্থায় মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে লোকটি মারা যায়। নওগাঁ : জেলার মান্দায় ছেলেধরা সন্দেহে ছয়জন মৎস্যজীবী গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। গতকাল সকালে উপজেলার কুসম্বা ইউনিয়নের বুড়িদহ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শিকার হন নওগাঁ সদর উপজেলার খাগড়া গ্রামের সাদ্দাম হোসেন (২৭), তাসলাম হোসেন (২৩), সাইফুল ইসলাম (৩৮), আবদুল মজিদ আকন্দ (৩৭), আনিসুর রহমান (২৭) ও রেজাউল করিম (২৮)। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ছোট মাছ ধরার জন্য পুকুর মালিক সনজিত চৌধুরী ছয়জন মৎস্যজীবীকে নিয়ে আসেন। চুক্তি ছিল পুকুর মালিক নেবেন মাছের ৭০ ভাগ এবং মৎস্যজীবীরা ৩০ ভাগ। এ শর্তে সকাল থেকে ছয়জন মৎস্যজীবী পুকুরে মাছ ধরছিলেন। এ সময় মৎস্যজীবীরা বেশ কয়েকটি বড় কাতল মাছ গোপনে বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখেন। পুকুর মালিক বিষয়টি টের পেয়ে বস্তা দেখতে চাইলে মৎস্যজীবীরা দেখাতে রাজি হচ্ছিলেন না। এক সময় তারা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এতেই ঘটে বিপত্তি। এলাকার লোকজন ছেলেধরা সন্দেহে চিৎকার দিয়ে তাদের ধরে গণপিটুনি দেন। সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে তাদের উদ্ধার করে পুলিশ। দিনাজপুর : ছেলেধরা সন্দেহে দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে মো. মিরু মিয়া (৫০) নামে এক ব্যক্তি গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। দুপুর ১২টার দিকে চিরিরবন্দর উপজেলার ভিয়াইল ইউনিয়নের নানিয়াটিকর গ্রামের মুহুরীপাড়ায় এ ঘটনাটি ঘটেছে। আটক মিরু মিয়া কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর আবদুল হাইয়ের ছেলে। পরে লোকটি পাগল চিহ্নিত হওয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

কিশোরগঞ্জ : জেলার বাজিতপুরে ছেলেধরা সন্দেহে এক পাগল গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। তার নাম ফজলু মিয়া (৫৫)। বাড়ি কুলিয়ারচর উপজেলার আলী আকবর গ্রামে। শনিবার সকালে বাজিতপুর উপজেলার গাজীরচর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

কুমিল্লা : ছেলেধরা সন্দেহে নারীসহ চারজনকে গণপিটুনি দিয়ে আহত করা হয়েছে। গতকাল কুমিল্লা সদর উপজেলার আমড়াতলী ইউনিয়নের দুতিয়া দিঘির পাড় ও মাঝিগাছায় এলাকায় পৃথক ঘটনা দুটি ঘটে। দুতিয়া দিঘিরপাড়ে গণপিটুনিতে আহতরা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বেজোড়া গ্রামের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে একজন নারী এবং দুজন পুরুষ রয়েছেন। এদিকে ছেলেধরা সন্দেহে আরিফ (৩০) নামে এক যুবককে মাঝিগাছায় গণপিটুনি দিয়ে আহত করা হয়েছে। আরিফ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার নয়নপুর গ্রামের আবদুর নূর স্বর্ণকারের ছেলে। লালমনিরহাট : ছেলেধরা সন্দেহে মানসিক প্রতিবন্ধী এক নারী গণপিটুনিতে আহত হয়েছেন। এ সময় তাকে রক্ষা করতে গিয়ে আহত হয়েছেন জিল্লুর রহমান নামে এক এসআই। শনিবার রাতে জেলা শহরের কলাবাগান কলোনি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।  নাটোর : ছেলেধরা সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনি দেওয়ার সময় উদ্ধার করেছে পুলিশ। নাটোর থানার ওসি কাজী জালাল উদ্দিন জানান, দুপুরে শহরের হাফরাস্তা তালতলায় এক যুবককে ঘোরাফেরা করতে দেখে এলাকাবাসী ধরে গণপিটুনি দিতে থাকে। পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশ জানায়, আলোচিত ওই ব্যক্তি মানসিক প্রতিবন্ধী। আড়াইহাজার (নারায়ণগঞ্জ) : আড়াইহাজারে ছেলেধরা  সন্দেহে ৬০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধাকে  পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছেন এলাকাবাসী। গতকাল সকাল ৮টার দিকে উপজেলার সদর পৌরসভার মসজিদ  এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আড়াইহাজার থানার ওসি (তদন্ত) শফিকুল ইসলাম জানান, সকাল ৮টার দিকে ওই নারীকে উপজেলা পরিষদ মসজিদের আশপাশে ঘুরাফেরা করতে দেখে এলাকাবাসীর সন্দেহ হয়।

বগুড়া : জেলার সান্তাহারে মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয়রা গণপিটুনি দিয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করায় প্রাণরক্ষা হয়। গতকাল সকাল ১০টায় পৌর শহরের লকু কলোনি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মানসিক ভারসাম্যহীন ওই ব্যক্তি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সাজাপুর গ্রামের আবদুল খালেকের ছেলে আফজাল হোসেন (৪২)।

টাঙ্গাইল : ছেলেধরা সন্দেহে তিনজনকে গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শহরের শান্তিকুঞ্জ মোড়, সদর উপজেলার কান্দিলা ও কালিহাতির সয়া পালিমা গ্রামে এসব ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দুজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে গণপিটুনির শিকার একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তার নাম আকাশ (৪২)। তিনি গাজীপুরের জয়দেবপুর উপজেলার মৃত আবদুর রহমানের ছেলে। 

নেত্রকোনা : দুপুরে সুমাইয়া (২৫) নামের এক নারীকে ধাওয়া করে আটক করেছে জনতা। স্থানীয় শহীদ মিনারের সামনে থেকে আটক নারীকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। নারীটি জয়পুরহাটের ছানাউল হকের মেয়ে বলে পরিচয় দেয়। স্থানীয়রা জানান, সকাল থেকেই ওই এলাকায় ঘুরাঘুরিতে সন্দেহ হচ্ছিল তাদের।

এদিকে এই পর্যন্ত মোট তিন নারীসহ ছেলেধরা সন্দেহে ১৩ জনকে আটক করেছে পুলিশ। তাদের মধ্য থেকে নয়জনকে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে সমাজসেবা অধিদফতরের ময়মনসিংহের ত্রিশাল ধলা আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে বলে জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুল আলম।

পাবনা : ছেলেধরা সন্দেহে জনতার হাত থেকে এক নারীসহ তিনজনকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল বিকালে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা  থেকে জহুরুল ইসলাম (৩০) ও জিয়াউদ্দিন (৩৫) নামের দুজন ও সদর উপজেলার ভাড়ারা ইউনিয়নের দড়িভাউডাঙ্গা গ্রাম থেকে সোনিয়া খাতুন (২২) নামে এক নারীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।

সোনিয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর গ্রামের মো. মঞ্জুর হোসেনের মেয়ে। সোনিয়া বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ভিক্ষা করে জীবিকানির্বাহ করেন বলেও জানান পুলিশ।

জহুরুল ও জিয়াউদ্দিন মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরে। তারা নিজেদের নাম ছাড়া কিছুই বলতে পারেন না। তারা রোহিঙ্গা বলে ধারণা করছে পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

রাজশাহী : নগরীর বিনোদপুর মিজানের মোড় এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে তিনজনকে গণপিটুনি দিয়েছে এলাকাবাসী। এ সময় তাদের কাছে থাকা মাইক্রোবাসটি ভাঙচুর করে এলাকাবাসী। গতকাল দুপুরের ঘটনার পর পুলিশ গিয়ে এলাকাবাসীকে শান্ত করে ওই তিনজনকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে।

মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান জানান, ওই তিন ব্যক্তি একটি কোম্পানির প্রচারের জন্য শিশুদের চিপস খাওয়াচ্ছিলেন। এ সময় লোকজনের সন্দেহ হলে তারা কোন কোম্পানি থেকে এসেছেন জানতে চান। এ সময় তারা পরিচয়পত্র দেখাতে ব্যর্থ হন। এতে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হন তারা। পরে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর