মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা
সেই শশাঙ্ক ব্যানার্জির এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার-৬

ভুট্টোর প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে

পীর হাবিবুর রহমান

ভুট্টোর প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে দিল্লি ফেরার পথে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শশাঙ্ক ব্যানার্জি

শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি বলেছেন, জীবিত অবস্থায় পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পাওয়ায় দিল্লির সাউথ ব্লকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অফিস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পুরো সচিবালয়জুড়ে এমন অকল্পনীয় আনন্দ উৎসব শুরু হয়েছিল, যেটি ৪৭ সালের ভারতের স্বাধীনতা লাভের আনন্দের পর আর দেখা যায়নি। ডিটেনশন থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর ভুট্টো ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে দেখা করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলে সম্ভাষণ জানালে স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা হিসেবে মুজিবও পাল্টা বলে বসলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তান নয়; পাকিস্তানেরও প্রধানমন্ত্রী। তাদের রসিকতা শেষ হওয়ার পর ভুট্টো তাকে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে আপনি বাংলাদেশ বানিয়েছেন। এখন ঢাকায় ফিরে গিয়ে নতুন দেশের নেতা হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারেন। বিদায়ের ঠিক আগে ভুট্টো মুজিবের কাছে জানতে চান, কখনো কোনো সময় বাংলাদেশ-পাকিস্তান এক হয়ে কোনো মৈত্রী জোট তৈরির সম্ভাবনা আছে কিনা? কিন্তু বিচক্ষণ শেখ মুজিব এই প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি। আমি যখন কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চাই, ‘মৈত্রী জোট’ বিষয়ে আসলে তার জবাব কি হতে পারত? তিনি এক কথায় বলেছিলেন, ‘আমার মৃতদেহের ওপরে।’ পরে দেখেছি, জুলফিকার আলি ভুট্টোর পাকিস্তান-বাংলাদেশ মৈত্রী জোট কল্পনাই থেকে গেছে।

শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি বলেন, ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন গল ব্লাডার অপারেশনের জন্য লন্ডন এলেন, তখন আমি বার্লিনে আমার স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছি। এমন সময় লন্ডন থেকে আমাদের হাইকমিশনার জার্মানি নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে বললেন, শেখ মুজিব লন্ডনে এসেছেন এবং ব্যানার্জিকে খুঁজছেন। আমাকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি তাড়াহুড়া করে লন্ডনে ফিরে এলাম। হাসপাতালে যখন ছুটে গেলাম তাকে দেখতে, তখন বললাম বঙ্গবন্ধু আপনার কি হয়েছে যে, আপনাকে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে আসতে হলো? তিনি তার শারীরিক অসুস্থতা ও যন্ত্রণার কথা বললেন। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তখন তার সঙ্গে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে রেণু বলেই ডাকতেন। আমিও প্রথম পরিচিত হওয়ার পর বলেছিলাম, আমিও আপনাকে রেণু বলে ডাকব। একজন অমায়িক, অতিথিপরায়ণ নারী হিসেবে তার সুনাম ছিল। আমার কথায় তিনি একটুও রাগ করলেন না। বললেন, ভাই অবশ্যই ডাকবেন।

বঙ্গবন্ধু সেদিন বললেন, ‘ব্যানার্জি, তোমার স্ত্রীর জন্য রেণু একটা উপহার নিয়ে এসেছে। তুমি একা এলে কেন? কাল তোমার স্ত্রীকে নিয়ে আসবে। আর রেণু বললেন, পরদিন আসার সময় তার পান খাওয়ার জন্য জর্দা নিয়ে আসতে। পরদিন আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে দেখা করতে গেলে তারা আমার স্ত্রীকে অনেক স্নেহ করেন। রেণু হালকা সবুজ রঙের একটি জামদানি শাড়ি আমার স্ত্রীকে উপহার দেন। তাদের এই চমৎকার উপহার পেয়ে আমার স্ত্রী খুব খুশি হন। পরে আবার যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একা দেখা করতে যাই, তখন একটি আকর্ষণীয় বিষয় আলোচনা করেন। বঙ্গবন্ধু চাইছিলেন, তার বাঙালি যেমন যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তেমনি পাকিস্তানের বেলুচ, সিন্ধু ও পশতুনরা যে স্বাধীনতা চাইছে সেটিও যুদ্ধ করে অর্জন করবে। এ ক্ষেত্রে তিনি চাইছিলেন তার সঙ্গে ভারত সাহায্যে এগিয়ে আসুক। তিনি বললেন, এই স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাদের সঙ্গে ব্যানার্জি তুমি ভারতীয়দের সঙ্গে একটি বৈঠক করিয়ে দিতে পারবে? আমি বললাম, আপনি আগে আলোচনা করে দেখুন তারা কি চায়? তারপর কথা বলতে পারি। বঙ্গবন্ধু হাসপাতালেই সে সময় লন্ডনে অবস্থানরত পশতুনের জাতীয়তাবাদী নেতা খান আবদুল ওয়ালি, বেলুচ জাতীয়তাবাদী নেতা আকবর খান বুগতি ও সিন্ধের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা জি এম সাইয়েদকে ডেকে পাঠান। তারা প্রায় এক ঘণ্টা হৃদয় উজাড় করে কথা বলেছেন। বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন।

?তিনি আমাকে বলেন, বেলুচিস্তান, সিন্ধু ও পশতুনের মানুষদের তিনি যৌথ স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনা শুরু করেছেন। আমি বুঝতে পারছিলাম, বিষয়টি আরও অনেক দূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। কিন্তু সেই আলোচনার ফলাফল বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। এই নেতারা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, এ মুহূর্তে তারা প্রস্তুত নন। তবে তারা আফসোস করেছিলেন। শেখ মুজিব যখন স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিয়ে বাঙালি জাতিতে সশস্ত্রযুদ্ধে নামিয়েছিলেন, তখন তারাও যদি স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করে দিতেন তাহলে সফল হতেন।

তারা এটাও বলেন, ভারত যদি তাদের বলত তাহলে তারা তখন শুরু করতে পারতেন। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, ভারত সরকার তো আমাকে স্বাধীন হতে বলেনি; আমি আমার স্বাধীনতার পরিকল্পনা নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে যখন শুরু করেছি তখন তারা সহযোগিতা দিয়েছে। বেলুচ জাতীয়তাবাদী নেতা আকবর খান বুগতি বললেন, ‘ইন্ডিয়া কো সামজা না, ফির একবার লাড়াই ক্যারনা হারামা আজাদি কি লিয়ে’। এই নেতাদের হতাশাজনক চিত্র বঙ্গবন্ধুর কাছে তিতে স্বাদের মতো লেগেছিল। তিনি তাদের প্রতি বেপরোয়াভাবে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘ব্যানার্জি, আমরা বাঙালিরা পাকিস্তানের ওই যোদ্ধা জাতির চেয়ে অনেক বেশি সাহসী। আমরা লড়াই করেছি এবং জিতেছি। কিন্তু ওরা ভীতু। আমি বেলুচ, পশতুন এবং সিন্ধের আলাদা কাঠামো দিতে চাই। কিন্তু তারা মনে করছে এখন ?উপযুক্ত সময় নয়। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আঘাতের মোক্ষম সময় এখনই। ওরা আসলে জানে না, আমি এবং আমার জনগণ পাকিস্তানে গণহত্যা এবং গণধর্ষণের ঘটনায় পাকিস্তানের বর্বর বাহিনীর প্রতি কতখানি তিক্ত হয়ে আছি।’

এর কয়েকদিন পর তারা পাকিস্তান চলে যান। জি এম সায়েদ ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি সিন্ধিদের জন্য ‘জিয়ে সিন্ধ’ সেøাগান তুলে স্বাধীনতার কম আর কিছু গ্রহণ করবেন না। এ কারণে তাকে পাকিস্তানি শাসকরা গ্রেফতার করে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করে। কারাগারে থেকেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সেই স্বাধীনতা-সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার নিজস্ব বিশ্লেষণ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম। আমি অনেক অবাক হয়েছিলাম যে বঙ্গবন্ধু অনেক ধৈর্য ধরে পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের নিয়ে আমার বক্তব্য শুনলেন। বঙ্গবন্ধু হেসেছিলেন, আমি যখন বলেছিলাম; বাংলাদেশের জন্ম সেনাশাসিত পাকিস্তানে পেন্ডুরার বাক্স খুলে দিয়েছে।

সর্বশেষ খবর