শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ফ্রীডম পার্টির সেই ৫০ অস্ত্রবাজ

ঢাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল ওদের হাতে

বিশেষ প্রতিবেদন

ফ্রীডম পার্টির সেই ৫০ অস্ত্রবাজ

বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশীদের ফ্রীডম পার্টির দুর্ধর্ষ ৫০ অস্ত্রধারীর নিয়ন্ত্রণে ছিল রাজধানী ঢাকা। ১৯৮৬ সাল থেকে পরবর্তী চার বছর পর্যন্ত ঢাকায় সংঘটিত প্রায় প্রতিটি সহিংস ঘটনায় এরাই ছিল মূল নায়ক। ছোট বড় অস্ত্র চালানো ও বোমা চার্জ করার বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই অস্ত্রবাজদের সঙ্গে নিয়েই চলাফেরা করতেন ফারুক, রশীদ আর বজলুল হুদা। ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে গ্রেনেড হামলার ঘটনা থেকে শুরু করে জাতীয় প্রেস ক্লাব বা ময়মনসিংহসহ ফ্রীডম পার্টির সবকটি হামলাতেই এদের সংশ্লিষ্টতা ছিল।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শীর্ষ এই অস্ত্রবাজদের কেউ নিহত হয়েছে। কেউ রয়েছে জেলে। অনেকেই প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়েছে। আবার অনেকে নিজেরাই খুনাখুনি করেছে।

ফারুক রশীদ তাদের ফ্রীডম পার্টির কার্যক্রম শুরু করে দেশের শীর্ষ স্থানীয় সন্ত্রাসী আর সর্বহারাদের নিয়ে। দলে যোগ দিলেই নতুন অস্ত্র আর অর্থ-এমন কথা ছড়িয়ে দেওয়া হয় তরুণ আর যুবকদের মাঝে। পাড়ায় মহল্লায় এমন তথ্য ছড়িয়ে দেয় নির্দিষ্ট কিছু বড় ভাইয়েরা। পাড়া মহল্লার বড় ভাইদের কাছে নিত্যনতুন অস্ত্র আর জিপ গাড়ি দেখে অনেকেই লোভে পড়ে যায়। দলে দলে যোগ দিতে থাকে শত শত তরুণ আর যুবক। এদের মধ্যেই ছিল পেশাদার অপরাধী আর টপটেরররা। এদের মধ্য থেকে আবার কয়েকশ যুবককে আলাদা করে পাঠানো হয় লিবিয়ায়। এসব যুবককে লিবিয়ায় গাদ্দাফির সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ত্রিপলিতে ঘুরিয়ে দেখানোর কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ফারুক আর রশীদ নিজেই তাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। আর অস্ত্র অর্থ সরবরাহ করতেন লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফি।

বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত অন্তত তিনশ যুবক তরুণকে ঢাকায় ফেরত এনে রাজনৈতিক সহিংসতার জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়। তবে এদের মধ্যে ৫০ জন দুর্ধর্ষ অপরাধীকে আলাদা করে ফারুক রশীদ আর বজলুল হুদা নিজেদের কাছে রাখতেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এই ৫০ অস্ত্রবাজই ঢাকার বিভিন্ন এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণও করত বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, রাজধানীর খিলগাঁও, সিপাইবাগ, তিলপাপাড়া, মেরাদিয়া, পূর্ব গোড়ান, মাদারটেক, ভুইয়াপাড়া, মোহাম্মদপুর, শান্তিনগর, শাহজাহানপুর, সবুজবাগ, মিলব্যারাক, ফরিদাবাদ, গেন্ডারিয়া, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, রায়েরবাজার, জিগাতলা, সূত্রাপুর, তেজগাঁও, বেগুনবাড়ী, মান্ডা, মুগদা, পূর্ব বাসাবো, গোড়ান, মতিঝিল এলাকাকে টার্গেট করে সদস্য সংগ্রহ করা হয়। সূত্র জানায়, রাজধানীর এই অস্ত্রবাজরা ছিল ঢাকা জেলার স্টাফ কো-অর্ডিনেটর ফারুক রেজার নিয়ন্ত্রণে। বলা যেতে পারে, ফ্রীডম পার্টির অস্ত্র গোলাবারুদ শাখার দায়িত্ব ছিল তার। লিবিয়ায় প্রশিক্ষিত এই ফারুক রেজা পরবর্তীতে নিজ দলের আরেক ক্যাডারের গুলিতে নিহত হয়। ফার্মগেট এলাকার দুর্ধর্ষ অস্ত্রধারী গাবু তাকে গুলি করে হত্যা করেছে বলে জানা গেছে। গাবু নিজেও ফ্রীডম পার্টির সদস্য। ফারুকের সঙ্গে রশীদের দ্বন্দ্ব শুরু হলে ফারুক রেজা খুন হয় প্রতিপক্ষের হাতে। তেজগাঁও এলাকার আরেক দুর্ধর্ষ অপরাধী আলাউদ্দিন ছিল ফ্রীডম পার্টির আরেক কো-অর্ডিনেটর। ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একজন আলাউদ্দিন তেজগাঁও বেগুনবাড়ী এলাকায় গণপিটুনিতে নিহত হয়। পুলিশসহ দুজনকে হত্যার পর পালিয়ে যেতে থাকলে লোকজন ধাওয়া করে আলাউদ্দিন ও তার ছোট ভাইকে পাকড়াও করে গণপিটুনি দেয়। এতে দুজনই নিহত হয়। তেজগাঁও এলাকার আরেক ফ্রীডম পার্টির অস্ত্রবাজ খালেক ওরফে পিচ্চি খালেক নিহত হয় পুলিশের পিটুনিতে। সেই অস্ত্রবাজদের মধ্যে আরও যারা ছিল ঢাকা মহানগর কমিটির সিটি কো-অর্ডিনেটর খন্দকার কাজল, ইকবাল আহমদ, হুমায়ন কবির এবং তেজগাঁও থানা কো-অর্ডিনেটর মোস্তাক আহম্মদ (কালু)। এ ছাড়া তেজগাঁওয়ের আবুল কালাম, আজিজুল হক বান্না, আলাউদ্দিন, রহিম, মকবুল, ভুলু, কাদের মামুন খালেক, সেলিম, আলী হোসেন, লাল মহাজন, বাশার। মতিঝিল থানার কো-অর্ডিনেটর হাদী নেওয়াজ খান বাহার, সবুজবাগ থানা কো-অর্ডিনেটর ভূঞা বাবুল। এ ছাড়া এই এলাকায় ছিলেন হুমায়ুন কবির, বাদল, সুভাষ, শরীফ, ইকবাল, কচি সোহরাব, মইনুল, ছোট কাজল ও বাবু। ডেমরা থানা কো-অর্ডিনেটর ইকবাল আহমদ, আমিনুল হক আমিন, সূত্রাপুর থানা কো-অর্ডিনেটর মঞ্জরুল হক কচি, মোহাম্মদপুর থানা কো-অর্ডিনেটর আমানুল্লাহ আমান, এ ছাড়া হুমায়ুন কবির সোহরাব, হালিম, টিটু, বাবু, সেলিম, ছোট বাবুল, জর্জ, মামুন, সালাউদ্দিন। নারায়ণগঞ্জের কো-অর্ডিনেটর কামাল আহমেদ, মোহাম্মদ হোসেন, ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর মো. শহীদুল্লাহ, তাজুল ইসলাম ফরিদ হোসেন, আকিলউদ্দিন, আকরাম আহাম্মদ, মোহাম্মদ টিপু, কে এম শোয়েন, কামাল ভূইয়া, ডাক্তার শোয়েব, মো. লতিফ, কাজী শরফুদ্দিন, হুমায়ুন কবির খান ও মিন্টু। ঢাকার সেন্ট্রাল এড়িয়ার স্টাফ কো-অর্ডিনেটর বাবলু রিবোরো, তেজগাঁও থানা কো-অর্ডিনেটর জাহাঙ্গীর চৌধুরী, মোস্তাক আহমেদ কালু। এ ছাড়া ছাত্রলীগ নেতা চুন্নু হত্যার আসামি রনি ও পিচ্চি আমান, ধানমন্ডি ১৯ নম্বরের টিপন, হারুন, তপু, রায়েরবাজারের বর্তমানে ডিস ব্যবসায়ী মামুন, মোহন, রামপুরার রইস, মিজান, তেজগাঁওয়ের সাইফুল, ধানমন্ডির বিপ্লব, এম এ কামাল, বর্তমানে ওয়াসার ঠিকাদার মিন্টু, মোহাম্মদপুরের বেহারি জাবেদ।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন : মির্জা মেহেদী তমাল, সাখাওয়াত কাওসার, গোলাম রাব্বানী ও মাহবুব মমতাজী)

সর্বশেষ খবর