সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিজ এলাকাতেই প্রতিরোধের মুখে খুনি রশীদ

ফ্রীডম পার্টির সেই নেতাদের কেউ আওয়ামী লীগ কেউ অন্য দলে

বিশেষ প্রতিবেদন

বঙ্গবন্ধুর খুনি রশীদের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনায়। পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হওয়ায় রশীদের এলাকা চান্দিনায় ফ্রীডম পার্টির একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ১৯৮৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে রশীদের ভাই খন্দকার আবদুল মান্নান কুমিল্লা-৬ (চান্দিনা) আসনে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপরও কুমিল্লায় ফ্রীডম পার্টি দাঁড়াতে পারেনি। ফ্রীডম পার্টির সশস্ত্র কর্মীরা কুমিল্লাবাসীর প্রতিরোধের  মুখে পড়েছে বার বার। আর কুমিল্লার যে ব্যক্তিদের নিয়ে ফ্রীডম পার্টি গড়ে তোলা হয়েছিল তাদের অনেকেই রাজনৈতিক ভোল পাল্টে ফেলেছেন। এদের কেউ শাসক দল আওয়ামী লীগে, আবার কেউ বিএনপি কিংবা এলডিপিতে।  জেলা ফ্রীডম পার্টির সাবেক কোষাধ্যক্ষ এবং চান্দিনা পৌরসভার সাবেক পৌর মেয়র আবদুল মান্নান সরকার বর্তমানে এলডিপি নেতা। জেলা ক্রীড়া পরিষদেরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছেন তাদের কেউ কেউ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কুমিল্লায় আওয়ামী লীগ নেতারা বার বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশীদের ফ্রীডম পার্টির বিরুদ্ধে। এরপরও তারা ঘুরেফিরে ঘাঁটি করার চেষ্টা চালিয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের (বর্তমানে এমপি) নেতৃত্বে যে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল, এরপর কুমিল্লায় আর ফ্রীডম পার্টির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।  যোগাযোগ করা হলে কুমিল্লার সদরের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার জানান, ’৯৬ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকন্যা চান্দিনা আসনের নির্বাচনের দায়িত্ব দেন। সেদিন নেত্রী আমাকে বলেছিলেন, তোমাকে এবার মনোনয়ন দেওয়া হলো না। তুমি চান্দিনাতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জন্য কাজ করবে। কারণ সেখানে খুনি রশীদ ভোট করছে। আমরা খুনি রশীদকে চিরতরে উচ্ছেদ করেছিলাম। এরপর থেকে ফ্রীডম পার্টি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তিনি বলেন, এর আগে সামরিক সরকার আমলে কুমিল্লা শহরে তাকে প্রতিহত করেছিলাম। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আরফানুল হক রিফাত সেই মামলায় আসামি হয়েছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে কুমিল্লা নগরীতে বর্তমান সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ আফজল খান ফ্রীডম পার্টির নেতাদের প্রতিহত করেছিলেন। নগরীর ফ্রীডম পার্টির অফিস ভেঙে দিয়েছিলেন। সূত্র জানায়, ’৮৮, ’৯১, ’৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে জেলার বিভিন্ন আসনে ফ্রীডম পার্টি সংসদ নির্বাচন করে। তবে তারা কেউ মারা গেছে, কেউ গা-ঢাকা দিয়েছে। কুমিল্লা-৩ আসন মুরাদনগর থেকে ফ্রীডম পার্টির নির্বাচন করে দ্বিতীয় হয়েছিলেন আহমেদ মির্জা খবির। এখন তিনি ঢাকায় অসুস্থ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। খন্দকার আবদুল মান্নান এখন ঢাকায় আছেন বলে জানা গেছে।

চান্দিনার বাসিন্দা কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন আহমেদ আলম জানান, ফ্রীডম পার্টির চান্দিনা উপজেলা কো-অর্ডিনেটর ছিলেন সাবেক পৌর মেয়র আবদুল মান্নান সরকার। এ ছাড়া উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোসলেহউদ্দিন, সাবেক কাউন্সিলর আবদুল জলিল ও রমিজ উদ্দিন চেয়ারম্যানসহ আরও অনেকে ফ্রীডম পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের মধ্যে রমিজ উদ্দিন বিএনপিতে এবং অন্যরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিগত সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক ঠেকাতে ফ্রীডম পার্টি থেকে পুনর্বাসিত এসব নেতাকে ব্যবহার করা হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে চান্দিনা উপজেলার মহিচাইল বাজারে নৌকা প্রতীকের কার্যালয়।

অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন আহমেদ আলম আরও জানান, বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল রশীদকে ধরে এনে তার সাজা কার্যকর করা হোক। তবে চান্দিনার কলঙ্ক কর্নেল রশীদকে চান্দিনার মাটিতে দাফন করতে দেওয়া হবে না।

কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম রতন বলেন, জসিম উদ্দিন ওরফে কাক্কু জসিম নামে একজনকে ফ্রীডম পার্টি করতে দেখেছি। সে বর্তমানে বিএনপির রাজনীতি করছে। কুমিল্লা মোগলটুলী এলাকায় হাইস্কুলের বিপরীতে দোতলায় ফ্রীডম পার্টির অফিস ছিল। ৯০ দশকে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আফজল খানের নেতৃত্বে অফিসটি ভাঙা হয়। অধ্যক্ষ আফজল খান বলেন, ১৯৮৯ সাল হবে। সেদিন ছিল ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী। জেলা অফিসে রান্নার আয়োজন হয়। শুনেছি কুমিল্লা চকবাজারে আমাদের অফিস ভাঙচুর করা হয়েছে। আমি গেটে এলে কয়েকজন পুলিশ সদস্য বাধা দেন। যেন বাইরে গিয়ে গ-গোল না করি। তাদের সরিয়ে দিয়ে আরও কয়েকজন নেতা-কর্মী নিয়ে হাঁটা শুরু করি। কান্দিরপাড় মসজিদের কাছে এলে আমাদের সামনে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ করা হয়। আমরা থামিনি। মোগলটুলী গিয়ে ফ্রীডম পার্টির অফিস ভাঙচুর করে তাদের লোকজনদের তাড়িয়ে দিই। কুমিল্লা জেলা ফ্রীডম পার্টির সাবেক কো-অর্ডিনেটর অ্যাডভোকেট নজির আহমেদ মনু বলেন, ’৮৭ সালে কুমিল্লা জেলা ফ্রীডম পার্টির কমিটি গঠিত হয়। প্রথম কো-অর্ডিনেটর ছিলেন সুয়াগাজী এলাকার শমসের হায়দার জাহাঙ্গীর। পরবর্তীতে তিনি দায়িত্ব নেন। জেলায় যারা এই দল করেছে তারা পরে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। ’৯১ সালের পর কুমিল্লায় কোনো ফ্রীডম পার্টি ছিল না। কাউন্সিল করে দল ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি। তবে চান্দিনার ফ্রীডম পার্টির নেতারা এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে আশ্রয় নিয়েছে।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন : মির্জা মেহেদী তমাল, সাখাওয়াত কাওসার, গোলাম রাব্বানী, মাহবুব মমতাজী ও মহিউদ্দিন মোল্লা)

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর