শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছি বহুবার

মে. জে. (অব.) কে এম সফিউল্লাহ, বীরউত্তম

নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছি বহুবার

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ছিলাম যুবক। একাত্তরের ৫ ডিসেম্বর আমরা সবাই ঢাকা দখলের সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়েছি। এ সময় বঙ্গোপসাগরে মার্কিনিদের সপ্তম নৌবহর আসতে থাকে। জবাবে সোভিয়েত ইউনিয়নও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অষ্টম নৌবহর প্রস্তুত রাখে। আমরা ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার আশপাশে অবস্থান করি। ১৬ ডিসেম্বর আমরা যখন চারপাশ দিয়ে ঢাকা অবরুদ্ধ করি তখন পাকিস্তান বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। এই আত্মসমর্পণে কোনো শর্ত ছিল না। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর সিভিল ও মিলিটারিতে বাঙালির অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালির অংশগ্রহণ ছিল ১ শতাংশের কম। ’৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) ছিল অরক্ষিত। ’৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল সামনে রেখে পাক সেনাদের উপস্থিতি ক্রমেই বাড়তে থাকে। তাদের সেনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করার একটি প্রক্রিয়াও করতে চেয়েছিল। তবে মূলত ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সেনাবাহিনীতে থাকা বাঙালি সদস্যরা প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। ’৭১-এর মার্চ ঘনিয়ে এলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেব না বলে সিদ্ধান্ত নিই। আমি ছিলাম জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড। ১৯ মার্চ ঢাকা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব জয়দেবপুরে আসেন বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি দেখে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। তাদের ফিরে যাওয়ার পর আমি সৈন্যদের নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করি। ২৫ মার্চ কালরাতে ওয়্যারলেসে একজনের গোপন মেসেজ শুনে ফেলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকসহ ৩০০ জনকে তারা মেরে ফেলেছে। এরপর আমাদের আর বসে থাকার সময় ছিল না। ৩টি ব্যাটালিয়ন নিয়ে জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহে আসি। ২৯ মার্চ সেনা, ইপিআর ও পুলিশবাহিনীসহ প্রায় ৩ হাজার সদস্যকে যুদ্ধের শপথবাক্য পাঠ করাই। এরপর সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি। যুদ্ধকালে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছি বেশ কয়েকবার। ফিরেছি আবার যুদ্ধে। মনে পড়ে ৬ ডিসেম্বরের কথা। ওই দিন তেলিয়াপাড়া থেকে আশুগঞ্জ যাচ্ছি। মাধবপুর আর চান্দুরার মাঝে একটি ব্রিজের ওপরে ব্যাক পজিশনে ছিল আমাদের কিছু সৈন্য যারা পথে কোনো বিপদ নেই এ ধরনের সংকেত দিলে আমরা রওনা হই। একটি গাড়ি আমাদের দিকে আসতে দেখে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার এটিকে আমাদের ব্যাটালিয়ন এমোনিশন গাড়ি মনে করে। ইসলামপুর নামক স্থানে গাড়িটি সামনে আসতেই বুঝতে পারি এটি এমোনিশন গাড়ি নয়, শত্রুসেনাদের গাড়ি। গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে বসা একজন জেসিও লাফিয়ে নেমে আমাকে জাপটে ধরে। ওই সময় আমার স্টেনগান ছিল ব্যাটম্যানের (সেনা অফিসারের সঙ্গে যিনি সবসময় থাকেন) কাছে। আর জেসিওর কাছে ছিল একটি রাইফেল। আমাদের দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি চলছিল বলে ব্যাটম্যান গুলি করতেও পারছিল না। একপর্যায়ে আমি জেসিওর শরীরে আঘাত করলে তার বাঁধন শিথিল হয়ে যায়। আমি তখন ব্যাটম্যানের রাইফেলটি দিয়ে জেসিওর মাথায় পর পর কয়েকবার আঘাত করি। একপর্যায়ে জেসিওর শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়লে মনে করি সে মারা গেছে। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি, পাশে একটা বড় বাস থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শত্রুসেনা নামছে। রাইফেলটি হাতে নিয়ে তাদের লক্ষ্য করে গুলি করতে গিয়ে দেখি রাইফেল ভাঙা। রাইফেল ফেলে পাউচে থাকা একটা পিস্তল দিয়ে গুলি করব কিন্তু জেসিওর স্টেনগানের আঘাতে সেটিও ভেঙে গেছে। উপায় না দেখে লাফ দিয়ে পড়ি পাশের নালায়। নালার কাদাপানিতে কিছুক্ষণ শরীর লুকিয়ে রাখি। কিন্তু কতক্ষণ আর পানিতে ডুবে থাকা যায়। কারণ এক সময় ওরা আমাকে দেখতে পাবে এবং মেরে ফেলবে। আমার পোশাক ছিল জলপাই রঙের। কাদাপানিতে ডুবে থাকার কারণে ছাই রং ধারণ করে ওদের পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। কাদাপানি থেকে উঠে এমন ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করি যেন আমি ওদের কোনো দলের দলনেতা এবং দল পরিদর্শন করছি। হাঁটতে হাঁটতে অদূরে একটি গ্রামের ভিতরে চলে যাই। কিছুক্ষণ পর আমার অন্য ব্যাটালিয়ন আমার সঙ্গে যোগ দেয় ও পরে গন্তব্যে পৌঁছাই।

 

সর্বশেষ খবর