মাত্র তিনটা পুরনো বেসামরিক এয়ারক্রাফট নিয়ে গঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রথম বিমানবাহিনী। আমাকে দেওয়া অটার এয়ারক্রাফটে শুধু ইঞ্জিন ও দিক নির্ণয়ের জন্য দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ের একটা কম্পাস ছাড়া কিছুই ছিল না। সেটা নিয়েই রাতের অন্ধকারে আমি আর ক্যাপ্টেন আকরাম উড়ে গেলাম চট্টগ্রামে। পরিকল্পনামাফিক ঠিক রাত ১২টা ১ মিনিটে গর্জে ওঠে আমাদের এয়ারক্রাফটের রকেটগুলো। মুহূর্তে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে চট্টগ্রাম অয়েল রিফাইনারির ফুয়েল স্টোরেজ ট্যাংকগুলো। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম এই প্লেন অপারেশনে ধ্বংস করে দেওয়া হয় পাকিস্তানিদের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা। অচল হয়ে পড়ে ট্যাংকসহ তাদের সব যুদ্ধ সরঞ্জাম। যুদ্ধের সময় আমি ছিলাম পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত। পোস্টিং পশ্চিম পাকিস্তানে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলোচনা চলছে পাকিস্তানের। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, পাকিস্তানিরা ধোঁকা দিচ্ছে। কারণ, ছয়টি এয়ারক্রাফট তখন শুধু পাকিস্তান থেকে ঢাকায় সৈন্য বহনের কাজ করছে। একটার দায়িত্বে ছিলাম আমি। আমি আমার মামার বন্ধু ব্যারিস্টার কে জেড আলমের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা পাঠালাম যে, ‘আপনি তো আলোচনা করছেন, আর আমরা তো সৈন্য নিয়ে আসছি।’ ২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা হামলা চালালো। আমাদের বৈমানিকদের ফ্লাইং বন্ধ করে দেওয়া হলো। বিমান বাহিনীর বাঙালিরা তখন ভাবছে কী করবে। আমি বেতন পাই মাসে তিন হাজার রুপি। খরচ হয় ২০০ রুপি। বাকিটা জমা। তখন ৯২৫ রুপিতে একটা মোটরসাইকেল পাওয়া যেত। ১৩ হাজার রুপিতে মিলত একটা টয়োটা গাড়ি। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দেশের জন্য এমন আয়েশি জীবন ছাড়ার পরিকল্পনা নিলাম। ভাবলাম, সৃষ্টিকর্তা দেশের জন্য লড়ার সুযোগ দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হলে আমাকে ও আমার পরিবারকে পুরো জাতি সারা জীবন স্মরণ করবে। যদিও এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মাত্র ৩ শতাংশ কর্মকর্তা। বাকিরা ওই শান্তির জীবন ছেড়ে আসেনি। পালানোর পরিকল্পনা করে সাত দিনের ছুটি নিয়ে করাচিতে আসলাম। ছুটি শেষে রাওয়ালপিন্ডি না গিয়ে সিভিলিয়ান কাপড় পরে ঢাকা চলে আসলাম। আমরা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কিছু সংখ্যক বৈমানিক, পিআইএ’র বৈমানিক এবং ৫৮ এয়ারম্যান নিয়ে একটা বিমান বাহিনী গঠন করা হয় এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে। ভারত সরকারের দেওয়া একটা বেজে ও তিনটা সিভিলিয়ান এয়ারক্রাফট দিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করি। ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হলো। ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল পিসি লাল এটা উদ্বোধন করলেন। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো অটার এয়ারক্রাফটে। সঙ্গে ছিলেন কো পাইলট ক্যাপ্টেন আকরাম। ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন প্রশিক্ষণরত অবস্থায় প্রথম ডিসি থ্রি এয়ারক্রাফট ক্রাশে মারা যান। নাগাল্যান্ড রাজ্যের ডিমাপুরে প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের বেসামরিক এয়ারক্রাফটে সামরিক সরঞ্জাম যুক্ত করা হলো। আমাদের এমন একটা টার্গেট দেওয়া হলো যেটা বাস্তবায়ন করতে পারলে পাকিস্তানের যুদ্ধের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমাকে টার্গেট দেওয়া হলো চট্টগ্রাম অয়েল রিফাইনারি ধ্বংস করার। কারণ জ্বালানি তেলের সরবরাহ বন্ধ হলে পাকিস্তানের যুদ্ধের শক্তি শেষ হয়ে যাবে। আমরা রিফাইনারি ধ্বংস করতে রাজি হলাম না। কারণ স্বাধীনতার পর আমরা তেল পাব কোথায়? শুধু স্টোরেজ ট্যাংক ধ্বংস করতে চাইলাম। সেটাই নির্ধারিত হলো। ২৮ নভেম্বর দিনক্ষণ ঠিক হলো। বাধা হলো বৃষ্টি। শেষে ৩ ডিসেম্বর গ্রিন সিগন্যাল পেলাম বিকাল ৪টার দিকে। আমরা ১২টা ১ মিনিটে রিফাইনারিতে এয়ার অ্যাটাক করব। আরেকটা হেলিকপ্টার যাবে নারায়ণগঞ্জের ফুয়েল স্টোরেজ ধ্বংস করতে। দুটারই টার্গেট সময় ১২টা ১ মিনিট। রাত পৌনে ৮টার দিকে ভারতের কমলপুর থেকে আমি ও ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ যাত্রা করলাম। হেলিকপ্টারটা আরেকটু পরে। ইঞ্জিন ও প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ের একটা কম্পাস ছাড়া দিক নির্ণয়ের আর কিছুই ছিল না এয়ারক্রাফটে। নেভিগেশনের কোনো উপায়ই ছিল না। নানা কৌশলে লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছি। ঠিক ১২টা ১ মিনিটে গর্জে ওঠে আমাদের এয়ারক্রাফটের রকেটগুলো। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে তেলের মজুদ। সাড়ে ছয় ঘণ্টায় সফলভাবে শেষ করি পুরো মিশন। এ ধরনের একটি বেসামরিক বিমান নিয়ে এত বড় অপারেশন আমার জীবনে একটা স্মরণীয় ঘটনা। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। আরাম-আয়েশের জীবন ছেড়ে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করার পুরস্কার পেলাম দুই বছরের সিনিয়রিটি। যুদ্ধের পরে যারা স্বদেশে ফিরেছেন তারা মনে করলেন সরকার আমাদের মারাত্মক উপহার দিয়েছেন! পরবর্তীতে একে একে মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ করে দেওয়া হয়েছে সার্ভিস থেকে। বঙ্গবন্ধুকেও শেষ করে দেওয়া হলো। তবে প্রাপ্তি নিয়ে আমার কোনো নালিশ নেই। শেষ ১০ বছর বাংলাদেশের অর্জন অভাবনীয়। আমি বাংলাদেশের মানুষের অর্জনে গর্বিত। এখন ডলারের বিপরীতে আমাদের কারেন্সি ভ্যালু ৮৫ টাকা। সেখানে পাকিস্তানের ১৫৬ রুপি। গ্রামের ৯৫ ভাগ শিশু স্কুলে যাচ্ছে। এটাই আমার অর্জন। লেখক : ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম বীর উত্তম। অনুলেখক : শামীম আহমেদ
শিরোনাম
- গাইবান্ধার দুই এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ে এসএসসিতে শতভাগ ফেল
- খুলনায় বাসার সামনে যুবদল নেতাকে গুলি করে হত্যা
- ভালুকায় দাখিল পরীক্ষায় শীর্ষ অবস্থানে দারুননাজাত মডেল মাদ্রাসা
- থিম্পুতে চলছে এসপিবিএ ভুটান আর্টক্যাম্প ২০২৫
- মুন্সীগঞ্জে এতিম শিক্ষার্থী ও ছিন্নমূল মানুষের মাঝে আহার বিতরণ বসুন্ধরা শুভসংঘের
- পি-২২: পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো সিংহ হয়ে উঠল পরিবেশ আন্দোলনের মুখ
- শাবিপ্রবিতে আয়োজিত হচ্ছে ‘রেইজ ফর জাস্টিস’ ম্যারাথন, চলছে রেজিস্ট্রেশন
- ডিমের বাজারে স্বস্তির হাওয়া, বেড়েছে বিক্রি
- ৫ বলে ৫ উইকেট, ক্রিকেটে নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়লেন ক্যাম্ফার
- ৫ বিভাগে ভারী বর্ষণের আভাস, বাড়বে গরমের অনুভূতি
- গায়ানাকে গুঁড়িয়ে ৮ রানে জয় রংপুরের
- রাজধানীতে বৃষ্টির সম্ভাবনা, কমতে পারে তাপমাত্রা
- সারা বছর সুস্থ থাকতে নিয়মিত খান এই ৭টি খাবার
- খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের হত্যা করল ইসরায়েলি বাহিনী
- ইরান ভ্রমণে না যেতে যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান
- দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন ফের গ্রেপ্তার
- দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে ব্যবসায়ী নিহত
- এসএসসিতে ফেল : বরিশালে পাঁচ ছাত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টা, দুইজনের মৃত্যু
- এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস না পেয়ে বগুড়ায় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
- টানা বৃষ্টির প্রভাব রাজধানীর বাজারে
১২টা ১ মিনিটে গর্জে ওঠে এয়ারক্রাফটের রকেট
শামসুল আলম বীরউত্তম
প্রিন্ট ভার্সন

এই বিভাগের আরও খবর
সর্বশেষ খবর