শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

গুলিবিদ্ধ হয়ে আট মাস পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী ছিলাম

শমসের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রম

গুলিবিদ্ধ হয়ে আট মাস পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী ছিলাম

আমি তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো রাস্তা ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে আমি চট্টগ্রাম অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলাম। সেদিনই যুদ্ধে যোগ দিলাম। দেশের সর্বস্তরের মানুষ এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। ছাত্র, শ্রমিক, যুবকরা অল্প কয়েকদিনের প্রশিক্ষণে জীবন বাজি রেখে রুখে দিয়েছিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদারদের।

১১ এপ্রিল ১৯৭১। আমার উপরে দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ঐতিহাসিক রেল ও সড়কসেতু রক্ষা করা। এই কাজ করতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করি। যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমি গুলিবিদ্ধ হই। গুরুতর আহত অবস্থায় আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। সেদিন থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী ছিলাম। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। পুরো আট মাস বন্দী থাকার পর ১৭ ডিসেম্বর আমি বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলাম। তাদের হাতে বন্দী থাকাকালীন নির্মম নির্যাতন নেমে এসেছিল আমার ওপর। প্রচ- রকমের শারীরিক মানসিক নির্যাতন করত আমাকে। পায়ে গুলি লাগায় হাঁটাচলা করতে পারতাম না। শুয়ে থাকা অবস্থায় খুব মারপিট করত। এর সঙ্গে চলত মানসিক নির্যাতন। আমার বিচারের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। অভিযোগপত্রে ছয়টি অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল আমার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সামরিক আদালতে আমার বিচার শুরু হওয়ার কথা ছিল। আমি জানতাম বিচার হলেই অবধারিতভাবে ফাঁসির মুখোমুখি হতে হবে। একবার রায় হলে তারা অবশ্যই কার্যকর করবে। কারণ আমি সেনাবাহিনীর সদস্য হয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। কিন্তু সে বিচার প্রক্রিয়া আর শেষ করতে পারেনি। তার আগেই পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্র্পণ করতে হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙালির অসীম ত্যাগের ফসল। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য ছিল এ লড়াই। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা সে রাষ্ট্র পেলাম। গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। এটাই আমাদের বড় অর্জন। হাতে জীবন নিয়ে যুদ্ধ করে গেছি দেশমাতৃকার জন্য। এই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গেলে স্মরণ করতে হয় যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন তাদের কথা। লাখো নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন। দেশকে নিঃস্ব করার কোনো চেষ্টা বাদ দেয়নি পাকিস্তানি বাহিনী। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। মানুষের এই নিঃস্বার্থ ত্যাগকে শুধু ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সীমিত রাখলে চলবে না। তরুণদের মনে জাগিয়ে তুলতে হবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের এই চেতনাকে। অনুলিখন : জয়শ্রী ভাদুড়ী

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর