‘বিজয় তুমি বিশ্ব মানচিত্রে নতুন একটা বাংলাদেশ/ বিজয় তুমি ছিনিয়ে এনেছো সোনার বাংলাদেশ’। সেই বাংলাদেশ আজন্ম আগলে রেখেছে মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের স্মৃতিগুচ্ছ। আনন্দ-বেদনার কত স্মৃতি পরম মমতায় আগলে রেখেছেন একাত্তরের যোদ্ধারা। দেশমাতৃকার সেই বীর সন্তানেরা জাতির গর্ব, সর্বকালের সর্বশ্রদ্ধেয়। কত মুক্তিযোদ্ধা সেই যুদ্ধদিনে হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে শহীদ হয়েছেন। তারা আজ দেয়ালে টানানো ছবি। ৩০ লাখ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন, আড়াই লাখ নারী সম্ভ্রম খুইয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য, ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের এই দিনটির জন্য। তাদের আত্মবলিদানের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা। লাল-সবুজ পতাকা। এই স্বাধীনতা এই পতাকার স্রষ্টা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ আজ উদযাপন করছে মহান বিজয় দিবসের আটচল্লিশতম বার্ষিকী। সারা দেশে সর্বস্তরের মানুষ মেতেছে একাত্তরের সেই বিজয় দিনের স্মরণে বিজয়ের আনন্দে। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। যার উদ্যোক্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ’৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নিমগ্ন বাঙালির ওপর হামলে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সেই ভয়ঙ্কর রাতে আক্রান্ত জাতির আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিব ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। জন্ম হয় নতুন জাতির। শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ, মহান মুক্তিযুদ্ধ। এরপর দীর্ঘ নয় মাস হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা সারা দেশে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। প্রায় এক কোটি মানুষ জন্মভূমি ছেড়ে শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ডিসেম্বরের শুরুতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর হাতে মার খেয়ে একে একে অধিকৃত এলাকা ছেড়ে ঢাকায় এসে আশ্রয় নিতে থাকে দখলদার পাকিস্তানি সেনারা। ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈনিক মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণ করে যৌথবাহিনীর কাছে। পাকিস্তানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় বাঙালির বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, শেখ মুজিবের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু তখন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ সকালে জাতির পক্ষ থেকে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্মৃতিসৌধের বেদিমূলে দাঁড়িয়ে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করবে স্বাধীনতার অমর শহীদদের। তাদের স্মৃতি চিরঅম্লান। সেই সঙ্গে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করা হবে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি বাঙালি জাতিকে এনে দিয়ে গেছেন স্বাধীনতা। আর যারা বাংলাদেশ ছিনিয়ে এনেছিলেন, সেই ১৬ ডিসেম্বর ফিরেছিলেন বিজয়ীর বেশে, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবময় ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে জাতি। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ছিল দেশমুক্তির ব্রত। শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করা হবে সেই স্বর্ণগর্ভা মায়েদের, যারা দেশের মুক্তির জন্য নিজেদের ছেলেমেয়েকে উৎসর্গ করেছেন, সেসব বোনকে যারা স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন নিজেদের সম্ভ্রম।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন। বাণী দিয়েছেন বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জাতীয় নেতারা। আজ সাধারণ ছুটি। সরকারি ও বেসরকারি বেতার ও টেলিভিশন স্টেশন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করছে। জাতীয় সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। রাজধানীতে আয়োজন করা হয়েছে কুচকাওয়াজ, বিজয় র্যালি।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগ দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সূর্যোদয়ের সময় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সব সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। এরপর সকাল আটটায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। সকাল ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, জিয়ারত ও মিলাদ মাহফিল হবে। এছাড়াও গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আজ বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এমপি, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, শ্রম ও জনশক্তিবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ প্রমুখ অংশগ্রহণ করবেন।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে আগামীকাল বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিজয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে আরও বক্তব্য রাখবেন জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা।
২ দিনের কর্মসূচি বিএনপির : ২ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। আজ সকালে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও পরে শেরেবাংলা নগরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ, আগামীকাল দুপুরে ঢাকায় বিজয় র্যালি এবং মহানগর নাট্যমঞ্চে বিজয় দিবসের আলোচনা সভা। বিজয় দিবসের দিন নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়সহ সারা দেশের দলীয় অফিসে আলোকসজ্জা করা হবে। দিবসটি উপলক্ষে বিশেষ পোস্টার প্রকাশ করবে বিএনপি। মুক্তিযোদ্ধা দলের উদ্যোগে আলোচনা সভাও হবে। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির বাইরে সারা দেশে জেলা ইউনিটগুলোও নিজস্ব সুবিধা অনুযায়ী বিভিন্ন কর্মসূচি করবে।