রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ভোটের মাঠে সন্ত্রাসীদের মহড়া

পছন্দের কাউন্সিলরকে জেতাতে মরিয়া, আত্মগোপনে থাকারাও প্রকাশ্যে, হামলা-হুমকি

মির্জা মেহেদী তমাল

ভোটের মাঠে সন্ত্রাসীদের মহড়া

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের মাঠে সন্ত্রাসীদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দলে দলে মহড়া দিচ্ছে নিজ নিজ কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থনে। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা ভয়ঙ্কর অপরাধীদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে আসতে থাকায় আতঙ্ক ছড়াচ্ছে জনমনে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি এলাকায় হুমকি-ধমকি ছাড়াও হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলার শিকার হয়েছেন কাউন্সিলর প্রার্থী নিজেও।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, ঢাকার নিয়ন্ত্রণে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা সিটি নির্বাচনকে কাজে লাগাতে চাইছে। যে গ্রুপের বেশি কাউন্সিলর জয়ী হবে, ঢাকার নিয়ন্ত্রণও সেই গ্রুপেই যাবে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারাগার বা বিদেশে আত্মগোপনে থেকেও জড়িত রয়েছে এই নির্বাচনে। অপরাধীদের আনাগোনায় পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ভাবিয়ে  তুলেছে। বিশেষ করে কিশোর গ্যাং নিয়েই দুশ্চিন্তাটা বেশি। এবারের সিটি নির্বাচনে কিশোর গ্যাং বেশি তৎপর বলে গোয়েন্দাদের কাছে খবর রয়েছে। তবে পুলিশ ও গোয়েন্দারা বলছে, এখনো পর্যন্ত সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। নজরদারির মধ্যেই রয়েছে গোটা শহর। অপরাধীরা যাতে কোনো ধরনের তৎপরতা চালাতে না পারে, সে ব্যাপারে গোপনে ও প্রকাশ্যে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

জানা গেছে, অর্ধশতাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী আছেন যারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মাঠে নেমেছেন। দুই দলের বাইরের নির্দলীয় প্রার্থীরা নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার লড়াইয়ে ইতিমধ্যেই কালো টাকা ছড়াচ্ছেন। এই কাউন্সিলর প্রার্থীদের ঘিরে নির্বাচন সামনে রেখে সন্ত্রাসী ও নাশকতা কর্মকান্ডের আশঙ্কা করা হচ্ছে বেশি। আর এই প্রার্থীরাই হলেন আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ‘নিজস্ব’ প্রার্থী। এদের বেশির ভাগ স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থী। যাদের অর্থ, অস্ত্র আর ক্যাডার দিয়ে সহায়তা করছে তারা। তবে সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের মধ্যে অন্তত ১৮ জন রয়েছেন, যাদের পেছনে রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। সূত্র জানায়, ঢাকা দক্ষিণের বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছে গোয়েন্দারা। এর মধ্যে ৯ নম্বর ওয়ার্ডকে নিয়েই ভাবছে বেশি গোয়েন্দারা। কারণ ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ক্যাসিনো রাজা মোমিনুল হক সাঈদের সমর্থনে ইতিমধ্যেই সন্ত্রাসীরা মহড়া দিতে শুরু করেছে। একই ওয়ার্ডে শাসক দলের প্রার্থী এবার তারই সহযোগী মোজাম্মেল। তার সমর্থনেও এই ওয়ার্ডে অপরাধীদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। দক্ষিণ ১ নম্বর ওয়ার্ডের নির্দলীয় প্রার্থী সাহাদাত হোসেন সাদুর সমর্থনে অপরাধীরা মহড়া দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সাদু ক্যাসিনো খালেদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।

সূত্রে জানা গেছে, সরকার সমর্থিত ১৮ জন বিতর্কিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সঙ্গে মাদক, চাঁদাবাজি ও দখলসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত সন্ত্রাসীদের সখ্য আছে এমন অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারও কারও সঙ্গে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরও যোগাযোগ থাকার অভিযোগ রয়েছে। তবে দুই সিটির মেয়র নির্বাচন ঘিরে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম।

সম্প্রতি ক্যাসিনোকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বাত্মক অভিযানের পর টালমাটাল হয়ে পড়ে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। প্রকাশ্যে থাকা দাগি প্রভাবশালী অপরাধীরাও আত্মগোপনে চলে যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে মাঠপর্যায়ের সন্ত্রাসীরা। আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে পড়ে তাদের। এ অবস্থায় ফাঁকা আন্ডারওয়ার্ল্ড দখলের নানা মেরুকরণ শুরু হয় শীর্ষ অপরাধীদের মধ্যে। দেশ-বিদেশ এমনকি জেলখানায় বসে তারা ঢাকা দখলে বৈঠক করছে। নির্দেশনা পাঠাচ্ছে অনুসারীদের কাছে। বিশেষ করে শীর্ষ দুই সন্ত্রাসী নতুন করে মাঠ দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এদের একজন কারাবন্দী কিলার আব্বাস, অপরজন লন্ডনে আত্মগোপনে থাকা জিসান। সংশ্লিষ্টরা বলছে, কিলার আব্বাস এবং জিসান এই মুহূর্তে আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আন্ডারওয়ার্ল্ডের হাতবদল করতে এক বছর ধরেই টপটেররদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। নানা সমীকরণ দেখা দেয় তাদের মধ্যে। দীর্ঘদিনের পলাতক ও দেশান্তরী শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ঢাকার নিয়ন্ত্রণে বিদেশে বসেই তৎপরতা চালাতে থাকে। চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে তার অনুসারীদের সক্রিয় রাখে। দুবাইয়ে থেকেই সে তার পরিকল্পনা মতো কাজ চালানোর চেষ্টা করতে থাকে। ক্যাসিনোকান্ডের আগে আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার ঠিকাদার জি কে শামীমসহ বেশ কয়েকজন ঢাকার গডফাদার দুবাই গিয়ে তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎও করেন। নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে আসতেন। আর কারাবন্দী কিলার আব্বাস ইতিমধ্যে ঢাকার মিরপুর, কাফরুল, ভাসানটেক, আগারগাঁও, শেওড়াপাড়াসহ উত্তরের বিরাট অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকারি টেন্ডারসহ সেখানকার চাঁদাবাজিও এখন তার নিয়ন্ত্রণে। জেলে বসেই এসব নিয়ন্ত্রণ করছে তার লোকজন দিয়ে। এখন সে পুরো ঢাকার নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। জিসানও রয়েছে সর্বাত্মক চেষ্টার মধ্যে। কারাগারে বন্দী কিলার আব্বাসও চায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ।

এরই মধ্যে শুরু হয় নির্বাচনের ডামাডোল। সূত্র জানায়, নির্বাচনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। নিজস্ব বাহিনী শক্তিশালী করতে গোপনে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। অস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলছে তারা। টার্গেট করে দলে ভিড়িয়ে বিভিন্ন এলাকার ‘কিশোর গ্যাং’-কে কাজে লাগানো শুরু করে। কিশোর গ্যাং এখন ঢাকা শহরে খুবই তৎপর।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর