বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

মারাত্মক ঝুঁকিতে চীন বাংলাদেশ বাণিজ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনাভাইরাসের কারণে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্য। ইতিমধ্যে সারাবিশ্বের সঙ্গে চীনের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ধরনের যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ প্রতিবছর সারা বিশ্ব থেকে যে পরিমাণ আমদানি করে তার ৩৫ শতাংশই করে চীন থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় সুতা এবং গার্মেন্টের কাপড়। এরপর আসে বিপুল পরিমাণে নানা ধরনের ইলেকট্রনিক্স পণ্য ও খুচরা যন্ত্রাংশ। বাংলাদেশ-চীন বার্ষিক আন্তবাণিজ্য পর্যায়ে বাংলাদেশ চীন থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। আড়াইশ থেকে তিনশ কোটি ডলার সমমূল্যের মতো পণ্য রপ্তানিও করে বাংলাদেশ। এসব আমদানি-রপ্তানি বর্তমানে বন্ধের উপক্রম। এতে সরকারের রাজস্ব আহরণও গুরুতর হুমকির মুখে পড়েছে। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিবছর এনবিআর ও কাস্টমসের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে সরকার, যা এখন হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে অর্থবছর শেষে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে চীন থেকে তিনটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। এসব জাহাজে এসেছে গার্মেন্ট পণ্য ও ফলমূল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনের এই অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে। তবে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে চীন সরকার যত দ্রুত টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারবে ভাইরাস তত দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসবে। ফলে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। নইলে এর নেতিবাচক প্রভাব কম-বেশি বিশ্বের সব দেশেই পড়বে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের প্রতিবছরের আমদানি বাণিজ্যের শতকরা ৩৫ ভাগই নির্ভর করে চীনের ওপর। এর মধ্যে রয়েছে গার্মেন্টের কাপড়, সুতাসহ আরও অন্যান্য পণ্য। এতে বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে করোনাভাইরাসের প্রকোপে সারা বিশ্ব এখন ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অনেক দেশে ছোট আকারে এই ভাইরাস ছড়ালেও চীনে মহামারী পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দেশটিতে গতকাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩৫০ ছাড়িয়েছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য-পর্যটন ক্ষেত্রে চীন  যেমন ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে একইভাবে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বহু দেশেও। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কারও শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়েনি। তবে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য, উন্নয়ন ও ভ্রমণকেন্দ্রিক যোগাযোগের পরিসর অনেক বড় থাকায় জনস্বাস্থ্য যেমন পড়েছে ঝুঁকির মুখে, তেমনি দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, চীন থেকে বছরে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। করোনাভাইরাসের কারণে চীন থেকে পণ্য জাহাজীকরণ, বুকিং এবং বিক্রি আপাতত বন্ধ রয়েছে। যেসব পণ্য দেশে আসছে সেগুলো এক মাস আগেই বুকিং করা। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি চীন সরকার সিদ্ধান্ত নেবে দেশটি এসব পণ্য সরবরাহ শুরু করবে কিনা। অনেক দেশ চীনের সঙ্গে আকাশপথে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশও চীনের নাগরিকদের আগমনী ভিসা বন্ধ করেছে। আকাশপথেও যাতায়াত স্থগিত হতে পারে। তবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছেন। চীন থেকে আমরা যেমন গার্মেন্ট পণ্য আমদানি করি একই রকম পণ্য আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ফ্যাক্টরিগুলোতেই উৎপাদিত হয়। ফলে এখন চীন থেকে না এনেও আমরা আমাদের গার্মেন্ট খাত সচল রাখতে পারব। এর ফলে খরচ কিছুটা বাড়বে। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ আমরা চীন থেকে যেমন আমদানি করি, তেমনি আবার রপ্তানির বিষয়ও জড়িত। তবে কী পরিমাণ ক্ষতি হবে সেটা এখনই বলা মুশকিল। এটা নির্ভর করছে এই পরিস্থিতিটা কতটা দীর্ঘায়িত হয় তার ওপর। বিজিএমএইএ সভাপতি রুবানা হক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে  জানান, তিনি এখন দেশের বাইরে রয়েছেন। তিনি বলেন, চীনের এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। কেননা বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাত এমনিতেই একটা প্রকট সমস্যার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। এরপর এই করোনাভাইরাসের অচলাবস্থা যদি দীর্ঘায়িত হয় তাতে আমাদের গার্মেন্ট খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে এই সুযোগে আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ কিছু কারখানাতে ইতিবাচক প্রভাবও পড়বে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে বাংলাদেশে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোতে শ্রমিক, কারিগরি সহায়তাকারী, প্রকৌশলীসহ পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ কাজ করছেন। শুধু পদ্মা সেতু প্রকল্পেই কাজ করছেন প্রায় ১১০০ চীনা নাগরিক। এদের মধ্যে সম্প্রতি ছুটিতে দেশে গিয়েছিলেন ২৫০ জন। তারা অবশ্য ফিরছেন। তবে কাজে যুক্ত হচ্ছেন না। এতে অবশ্য কাজ থেমে নেই। চীন ফেরত প্রকল্পের ১৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দাফতরিক কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পে যুক্ত চীনারা ছুটি শেষে ফিরছেন। কিন্তু তাদের ১৪ দিন পর্যবেক্ষণ শেষ না হলে কাজ করতে দেওয়া হবে না। এতে কিছুটা বিঘিœত হচ্ছে প্রকল্পের কাজ। ঢাকা বাইপাস সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত চীনের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা ছুটি নিয়ে দেশে গেছেন। আগামী মাসে তাদের ফেরার কথা। কিন্তু তারা সময়মতো ফিরতে পারবেন না বলে মনে করা হচ্ছে। এর ফলে মেগা প্রকল্পের কাজেও কিছুটা গতি কমে এসেছে। এমন পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে সংশ্লিষ্ট মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ সময়মতো শেষ করা সম্ভব হবে কিনা-এ নিয়েও জটিলতা দেখা দিয়েছ। এ ছাড়া পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা বাইপাস সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে চীনের নাগরিকরা বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত রয়েছেন। এসব প্রকল্পে দেড় হাজার চীনা নাগরিক কাজ করছেন। তার বাইরে আরও কিছু প্রকল্পে ৫০০ চীনা নাগরিক সহায়তা করছেন। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে যুক্ত ৩৫ চীনা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের শিল্প উৎপাদনের ৬০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি হয় চীন থেকে। বিশেষ করে ওষুধ শিল্পের ৯০ শতাংশ কাঁচামাল আসে চীন থেকে। চীনের করোনাভাইরাসের কারণে পরিস্থিতি এখন খুবই উদ্বেগজনক। সেখানে সব ধরনের শিল্প উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ওষুধ শিল্প খুব সংকটে পড়বে। আমাদের গার্মেন্ট খাতের পরিস্থিতি একই রকম। ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ পণ্য বেশির ভাগ চীন থেকে আসে। ফলে আরএমজি খাতের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, চীনের ওপর নির্ভরশীল শিল্প-কারখানা রয়েছে সারা পৃথিবীতে। আমাদের দেশের শিল্প খাতের বড় অংশ নির্ভরশীল চীনের ওপর। ফলে দ্রুত যদি করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে দেশের শিল্প খাতে।

ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম বন্দর : সমুদ্রপথে দেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। প্রায় ৯০ শতাংশ বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে থাকে এ বন্দরে। দেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি  হয়ে থাকে চীন থেকে। আমাদের চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের দেওয়া তথ্যমতে-প্রতি মাসে চীন থেকে ১৪-১৫টি কনটেইনার জাহাজ এবং ৪ থেকে ৫টি জেনারেল কার্গো জাহাজ আসে চট্টগ্রাম বন্দরে। প্রতিদিন চীনের বিভিন্ন বন্দর থেকে দেশি-বিদেশি পণ্যবোঝাই জাহাজ নিয়ে নাবিকরা আসেন চট্টগ্রাম বন্দরে। ফলে ‘করোনাভাইরাস’ ঝুঁকিতে রয়েছে এই বন্দর। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এই ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে নানা ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

সমুদ্রগামী জাহাজের মাধ্যমে মরণঘাতী এই ভাইরাস যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন এ বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নাবিকের পরিচর্যায় বন্দর মেডিকেল বিভাগের বিশেষ টিমকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালের উদ্যোগে ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে মৌলিক সুস্থতা অনুশীলনের নানাবিধ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বন্দরের হারবার ও মেরিন দফতরের এক জরুরি সভায় সমুদ্রপথে করোনাভাইরাস প্রবেশ প্রতিরোধে জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং এজেন্টের মাধ্যমে কোনো জাহাজ বহির্নোঙরে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে যথাযথ ঘোষণা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বন্দরে আসা জাহাজের মাস্টারকে পোর্ট লিমিটে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা দিতে হবে যে, ওই জাহাজে করোনাভাইরাস আক্রান্ত নাবিক নেই বা আছে। এ ছাড়া পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে আসা জাহাজগুলোতে শতভাগ নাবিকের পোর্ট হেলথ অফিসার স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে নিরাপদ ঘোষণা করলেই বন্দরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হবে। জাহাজ থেকে হাসপাতালে দ্রুত রোগী স্থানান্তরের জন্য বন্দরের অ্যাম্বুলেন্সশিপও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

এদিকে বন্দর ইমিগ্রেশন ডেস্কে পোর্ট হেলথ অফিসারের তত্ত্বাবধানে একটি মেডিকেল টিম সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। কোনো নাবিক বাইরে যেতে চাইলে মেডিকেল স্ক্রিনিংয়ে সুস্থতা সাপেক্ষেই শুধু অনুমতি দেওয়া হবে। এ ছাড়া সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে মাস্ক ও অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সবাইকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর