শিরোনাম
শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

বাণিজ্যে বড় আঘাত করোনাভাইরাসে

উদ্বেগে ব্যবসায়ীরা, সংকটে পোশাক-চামড়া শিল্প, ঝুঁকিতে নিত্যপণ্যের বাজার

রুহুল আমিন রাসেল

বাণিজ্যে বড় আঘাত করোনাভাইরাসে

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের করোনাভাইরাসের ব্যাপক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে। দেশের মোট আমদানির প্রায় ২৬ শতাংশই আসে চীন থেকে। রপ্তানিও কম নয়। চলমান পরিস্থিতিতে আমদানি-রপ্তানি বন্ধের উপক্রম হওয়ায় চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। এতে উদ্বিগ্ন সরকার। সামগ্রিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বাণিজ্য সচিব জরুরি বৈঠকে মিলিত হন।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআইর সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম গতকাল কানাডা থেকে টেলিফোনে বলেন, ‘করোনাভাইরাসে চীন আক্রান্ত হওয়ার প্রভাব বাংলাদেশসহ বিশ্ববাজারে পড়বে। আমরা চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করি। এর সরবরাহে সমস্যা হবে। বিষয়টি ইতিমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলেছি। পাশাপাশি উৎপাদনমুখী শিল্পে কোনো সমস্যা হলে ব্যাংকগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের পেমেন্টে ধীরগতি হলে বিবেচনা করা হবে আশা করছি।’

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করছে বাংলাদেশ। এখন সেই আমদানি কমায় উৎপাদন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রপ্তানি বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য নষ্ট হচ্ছে। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন উদ্যোক্তা। আবার আমদানির অভাবে স্থানীয় বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এখনই আমদানি-রপ্তানির জন্য বিকল্প রাষ্ট্র খুঁজতে হবে। এর প্রভাব মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এমন  প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে করোনাভাইরাসের প্রভাবের বিষয়ে আগামী তিন দিনের মধ্যে অংশীজনদের কাছে একটি প্রতিবেদন চেয়েছেন। তিনি গতকাল বলেন, চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামালে এ মুহূর্তে কোনো সমস্যা না থাকলেও সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে তা উদ্বেগের বিষয় হবে। ব্যবসায়ীরাও বিষয়টি পর্যালোচনা করছেন। অংশীজনদের পক্ষে এফবিসিসিআইর প্রতিবেদন পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সরকার। তথ্যমতে, গত আট বছরে চীন থেকে আমদানি বেড়েছে ৭৪৪ কোটি ডলার। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে চীনে রপ্তানি বেড়েছে ৪৩ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৩ কোটি ১২ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে আমদানি করা হয়েছে ১ হাজার ৩৮৫ কোটি ১১ লাখ ডলারের পণ্য। এর মধ্যে বস্ত্র খাতের সুতা ও কাপড় আমদানি হয়েছে ৪৩০ কোটি ৫৭ লাখ ডলারের। আর মেশিনারি ও ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ৩৬১ কোটি ১৪ লাখ ডলারের। এ ছাড়া রাসায়নিক, প্লাস্টিক ও রাবার জাতীয় পণ্য, যানবাহন ও জাহাজের যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করা হয় চীন থেকে। অন্যদিকে পোশাক, পাট, প্লাস্টিক ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, কৃষিপণ্য, আসবাবপত্রসহ নানা পণ্য রপ্তানি করা হয়। পোশাক তৈরির অধিকাংশ কাঁচামাল আনা হয় চীন থেকে। তাই করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে পোশাকশিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গতকাল বলেন, ‘পোশাকের সিংহভাগ ফেব্রিকই আমদানি হয় চীন থেকে। দেশটিতে অর্ডার করা পণ্যগুলো কখন এসে পৌঁছবে, তা নিশ্চিত নয়। ফলে পোশাকশিল্প বড় ধাক্কা খাবে। শুধু আমদানি নয়, চীনে রপ্তানির ক্ষেত্রেও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। চীনের ব্র্যান্ডগুলো এ দেশ থেকে পণ্য নেয়। সে ক্ষেত্রে তারা যেহেতু আসতে পারছে না। পণ্যও আমদানি করছে না। আবার অর্ডার করা পণ্য নিচ্ছেও না।’ এদিকে চামড়া জাতীয় পণ্যের রপ্তানিকারকরাও রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন-বিএফএলএলএফইএ বলছে, সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার-সিইটিপি চালু না হওয়ায় ইউরোপের ক্রেতারা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে চামড়া কিনছেন না। ফলে চীনে রপ্তানির ওপর নির্ভর করতে হয় চামড়া জাতীয় পণ্য ব্যবসায়ীদের।

এ প্রসঙ্গে বিএফএলএলএফইএর সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দিলজাহান ভূঁইয়া বলেন, ‘ইউরোপের ক্রেতারা না আসায় বর্তমানে ৭০ শতাংশ চামড়ার ক্রেতাই চীনা। কিন্তু এখন কারখানাগুলোয় ফিনিশড চামড়ার স্তূপ পড়ে আছে। চীনারা আমদানি করছে না। যেগুলোর অর্ডার দিয়েছে সেগুলোও নিচ্ছে না। করোনাভাইরাসের সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে এ খাত দারুণ ক্ষতির মুখে পড়বে।’ অন্যদিকে আদা, রসুনসহ বিভিন্ন মসলা জাতীয় পণ্য আমদানি করা হয় চীন থেকে। যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ থাকায় এসব পণ্যের সরবরাহ কমে যাচ্ছে। কারওয়ান বাজারের আদা-রসুন ব্যবসায়ী মাইনুল হোসেন বলেন, ‘সরবরাহ কমছে। কয়েক দিনের মধ্যে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে।’ জানা গেছে, বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে চাষা হওয়া কুঁচিয়া ও কাঁকড়ার পুরোটাই রপ্তানি হয় চীনে। মূলত দেশটিতে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিগত আট বছর বাণিজ্যিকভাবে কুঁচিয়া চাষ হচ্ছে। মৎস্য অধিদফতরের হিসাবমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে কুঁচিয়া উৎপাদিত হয়েছিল ১৭ হাজার টন। এ পণ্য রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ লাইভ অ্যান্ড চিল্ড ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন-বিএলসিএফইএর তথ্যমতে, কুঁচিয়া ও কাঁকড়া রপ্তানিতে বছরে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা আয় হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় চীনে- প্রায় ৯০ শতাংশ। বাকি ১০ শতাংশ রপ্তানি হয় থাইল্যান্ড, হংকং, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর ও মালয়শিয়ায়। এসব দেশে কাঁকড়া রপ্তানি হলেও কুঁচিয়া পুরোপুরি রপ্তানি হয় চীনে। গত ২৬ জানুয়ারি থেকে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এতে রপ্তানিকারক, সরবরাহকারী ও উৎপাদন বা সংগ্রহকারী এ তিন স্তরের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন ২৬ জানুয়ারির আগে ক্রেতারা যে ক্রয়াদেশ দিয়েছিলেন, সে অনুযায়ী রপ্তানিকারকরা পণ্য বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। কিন্তু এখন রপ্তানি করা যাচ্ছে না। এতে শুধু রপ্তানিকারকরাই নন, সরবরাহকারী ও উৎপাদনকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। জানা গেছে, চীনের এ অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে বিশ্বের বহু দেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সারা বিশ্বের সঙ্গে চীনের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ধরনের যোগাযোগ প্রায় বন্ধ। বাংলাদেশ প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে যে পরিমাণ আমদানি করে তার ৩৫ শতাংশই করে চীন থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় সুতা ও কাপড়। বিপুল পরিমাণ নানা ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য ও খুচরা যন্ত্রাংশ তো আসেই। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য, উন্নয়ন ও ভ্রমণকেন্দ্রিক যোগাযোগের পরিসর অনেক বড় থাকায় জনস্বাস্থ্য যেমন পড়েছে ঝুঁকির মুখে, তেমন দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সূত্র জানান, চীন থেকে বছরে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। করোনাভাইরাসের কারণে চীন থেকে পণ্য জাহাজিকরণ, বুকিং ও বিক্রি আপাতত বন্ধ রয়েছে। যেসব পণ্য দেশে আসছে সেগুলো এক মাস আগেই বুকিং করা। ১২ ফেব্রুয়ারি চীন সরকার সিদ্ধান্ত নেবে দেশটি এসব পণ্য সরবরাহ শুরু করবে কিনা। অনেক দেশ চীনের সঙ্গে আকাশপথে ফ্লাইট চলা বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশও চীনের নাগরিকদের আগমনী ভিসা বন্ধ করেছে। আকাশপথেও যাতায়াত স্থগিত হতে পারে। তবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছেন। চীন থেকে আমরা যেমন গার্মেন্ট পণ্য আমদানি করি একই রকম পণ্য আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ফ্যাক্টরিগুলোতেই উৎপাদিত হয়। ফলে এখন চীন থেকে না এনেও আমরা আমাদের গার্মেন্ট খাত সচল রাখতে পারব। তবে এর ফলে খরচ কিছুটা বাড়বে।

জরুরি বৈঠক করলেন বাণিজ্য সচিব : চীনের করোনাভাইরাস বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে যে ঝুঁকি তৈরি করেছে তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে সরকারের মধ্যে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গতকাল এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন। বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেছি, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে যে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করা হচ্ছে তা মোকাবিলায় সরকারের পক্ষে যা করণীয় সবই করা হবে। তবে তার আগে আমাদের জানতে হবে চীনের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে আমাদের কী কী সমস্যা হচ্ছে। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। ওই রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকারের করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’

সচিব জানান, ‘ব্যবসায়ীরা তৈরি পোশাক রপ্তানি আদেশ সময়মতো পশ্চিমা ক্রেতাদের বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এখন চীনে যে পরিস্থিতি হয়েছে, তাতে তো ব্যবসায়ীদের হাত নেই। সারা বিশ্বই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা তৈরি পোশাক ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলব।’ ‘আমাদের ব্যবসায়ীদের অনেক পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে চীনে। সেগুলো দ্রুত শিপমেন্টের পাশাপাশি, আমদানি-রপ্তানিতে নতুন করে এলসি করার ক্ষেত্রে যদি কোনো ধরনের বিধিনিষেধ থাকে তবে তা প্রত্যাহারে দূতাবাসগুলোকে সক্রিয় হওয়ার বিষয়েও নোটিস দেওয়া হবে’, জানান বাণিজ্য সচিব।

সর্বশেষ খবর