বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ব্যাংকের টাকা মেরে পাচার

বিদেশের মাটিতে বিলাসী- জীবন যাপন করছেন এমন প্রতারকদের চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধবিষয়ক সংস্থাগুলোর সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক

মানিক মুনতাসির ও আলী রিয়াজ

ব্যাংকের টাকা মেরে পাচার

ব্যাংকের টাকা মেরে বিভিন্ন সময় বিদেশে পালিয়ে গেছেন এমন শতাধিক লুটেরাকে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে কেউ কেউ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত তুলে নিয়েছেন নানা কৌশলে। তারা এখন দুবাই, কানাডা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিলাসী-জীবন যাপন করছেন। অথচ ঋণের টাকা তুলতে না পেরে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো এসব ঋণকে মন্দ ঋণ (খেলাপি) ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকি এদের কারণে একটি অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অবসায়ন করা হয়েছে। প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার নামে এক অখ্যাত ব্যবসায়ী একাই কয়েকটি ব্যাংক ও ননব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন। আর ইসা বাদশা ও মুসা বাদশা নামে দুই ভাই আটটি ব্যাংক থেকে ৫০০ কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীও অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ কামিয়েছেন। পাশাপাশি ব্যাংক থেকেও বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণ নিয়ে সে টাকা মেরে দিয়েছেন। আবার নিরাপদে দেশও ছেড়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আফজাল হোসেন যার নামে বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সন্ধান পায় দুদক। পরে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। এখন তিনি অস্ট্রেলিয়ায় বিলাসী-জীবন যাপন করছেন বলে জানা গেছে। একইভাবে ব্যাংক খাতের বড় জালিয়াতির পথপ্রদর্শক হিসেবে বিসমিল্লাহ গ্রুপ শুরুতে ব্যাংকের টাকা মেরে নিয়ে যায় দুবাইতে। এমন আরও অনেকে ব্যাংকের টাকা মেরে ব্যাংকক, দুবাই, অস্ট্রোলিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। সাম্প্রতিককালে ব্যাংকের টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম প্রশান্ত কুমার হালদার। তিনি একাই কমপক্ষে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেউই তাকে আটকাতে পারেনি। জানা গেছে, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে কমপক্ষে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। সেই চার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা এখন খুবই শোচনীয়। একটি বিলুপ্তির পথে, বাকি তিনটিও গ্রাহকদের পাওনা ফেরত দিতে পারছে না। নানা কৌশলে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলেছেন পি কে হালদার। শেয়ারবাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির বিপুল পরিমাণ শেয়ারও কিনেছেন, দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে টাকাও সরিয়েছেন। এমনকি দেশের বাইরেও তিনি এখন কোম্পানি খুলেছেন। শুধু তাই নয়, কৌশলে তিনি একাধিক ব্যাংক ও অবাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বনে যান। এমনকি তিনি নতুন প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডিও ছিলেন। কিন্তু তিনি পলাতক। আর আমানতকারীরা দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন টাকা ফেরত পাওয়ার আশায়। প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ৮ জানুয়ারি পি কে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতে জবাবদিহির চরম সংকট বিরাজ করছে। একজন মানুষ কীভাবে একই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে থাকছেন আবার ঋণও নিচ্ছেন নিজ নামে। এসবের পেছনে হয়তো আরও কোনো গল্প থাকতে পারে। এরা কারও না কারও সহায়তা নিয়ে এসব করছেন। ফলে ব্যাংক খাতে একটা শুদ্ধি অভিযান সময়ের দাবি। কেননা ব্যাংকের টাকা লুট করা এবং প্রতারণা এসব এখন সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এসব বিষয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।’ জানা গেছে, ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় চম্পট দিয়েছেন বেলায়েত নামে এক ব্যবসায়ী। বেসিক ব্যাংক থেকে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে তিনি এখন কানাডায়। সেখানে নিশ্চিত-জীবন যাপন করছেন। স্ক্র্যাপ (জাহাজভাঙা) ব্যবসায়ী গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু ওরফে জি বি হোসেনের বিরুদ্ধে বেসিক ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় নাম উঠে আসার পর দুদক প্রথমে তার পাসপোর্টের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু তাকে আটকানো যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, নিষেধাজ্ঞার পরও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকেরই এক বা একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা ও পরিচালকের সহায়তায় তিনি কানাডায় চলে গেছেন। এখন দুদকে মামলা ঘুরছে তবে বেলায়েতের কিছুই হয়নি। জানা গেছে, চারটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের জন্য জাহাজ আমদানির নাম করে বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে মোট ১২৫ কোটি টাকা ঋণ নেন বেলায়েত। কিন্তু কোনো জাহাজ আমদানি করেননি। বেলায়েত নেভিগেশন কোম্পানির নামে ২৪ কোটি, রিলায়েন্স শিপিং লাইনসের নামে ১৬ কোটি, এসবিআই শিপিং লাইনের নামে ১৫ কোটি এবং বে নেভিগেশনের নামে ৭০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। এ ছাড়া আরও ১২টি কোম্পানির নামে আরও ১৫০ কোটি টাকা ঋণ নেন বেলায়েত। এই গাজী বেলায়েত এখন কানাডার টরন্টোয় থাকেন। টরন্টোয় তার ৮-১০টি পেট্রল পাম্পসহ কলাপাতা নামের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টও রয়েছে। ২০১৫ সালে সেখানকার হিল ক্রেস্ট স্কারবোরোয় ২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার দিয়ে একটি বাড়িও কিনেছেন বলে জানা গেছে। দুদকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অগ্রণী ব্যাংকের ২৫৮ কোটি ৫৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা ও বিডিবিএল থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করে লাপাত্তা দুই ব্যবসায়ী। মাররীন ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান, একই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির আহমেদ অগ্রণী ব্যাংকের এ টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন মালয়েশিয়ায়। সেখানে তারা বিলাসী-জীবন যাপন করছেন। এ ছাড়া টিপু সুলতান বিডিবিএল থেকে আরও প্রায় ১০০ কোটি টাকা নিয়ে আর ফেরত দেননি। নানা ধরনের ব্যবসায়িক কাগজপত্র দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২০০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে একটি পরিবার। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করে উল্টো ব্যাংকের বিরুদ্ধে আদালতে রিট করে পালিয়ে গেছে তারা। বগুড়ায় আটা ময়দা সুজির ব্যবসায়ী রিমা ফ্লাওয়ার মিল ও মাহিন আটা ময়দা সুজি নামের প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে এ ঋণ নিয়েছেন তারা। প্রতিষ্ঠানটির মালিক জহুরুল হক মোমিন ইসলামী ব্যাংকের বগুড়া শাখা, প্রাইম ব্যাংক, এসআইবিএল থেকে ১৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন। তার স্ত্রীর নামেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ঋণ রয়েছে। মোমিনের ভাই এনামুল হক বাবু এবং তার স্ত্রী আইরিন হক সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বগুড়া শাখা থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ায় ব্যাংক মামলাও করে। পরে জামিনে বের হয়ে ব্যাংকের বিরুদ্ধে রিট মামলা করে দেশ থেকে চলে গেছেন তারা। এখন তাদের খুুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

জানা গেছে, ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন আরেক প্রতারক ব্যবসায়ী এরশাদ আলী। এরশাদ ব্রাদার্স নামের প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করছে না। এর মধ্যে এ বি ব্যাংকেরই রয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। বারবার তাগিদ দিয়েও পরিশোধ না করায় এ বি ব্যাংকের মামলায় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মো. এরশাদ আলীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়না জারি হয়েছে। এ বি ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং শাখা থেকে ২০১০ সালে ১১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রড, সিমেন্টসহ পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এরশাদ ব্রাদার্স। ধীরে ধীরে ঋণের সীমা বেড়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দাঁড়ায় ১৩৯ কোটি টাকায়। জানা গেছে, এরশাদ ব্রাদার্স শুধু এ বি ব্যাংকেরই ঋণখেলাপি নয়, আরও চারটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার ব্যাংকের ৮৩ কোটি ২৯ লাখ ৩৮ হাজার, ব্র্যাক ব্যাংকের ১৫ কোটি ৫ লাখ ২৭ হাজার, সাউথইস্ট ব্যাংকের ৫ কোটি ৮৯ লাখ ২০ হাজার ও ফনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ২৯ কোটি টাকা রয়েছে। এসব ঋণ পরিশোধ না করে এরশাদ আলী দেশ ছেড়ে চলে গেছেন।

এদিকে আপন দুই ভাই ইসা বাদশা ও মুসা বাদশা। তাদের বাবা বাদশা মিয়া সওদাগর চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে গড়েছিলেন বাদশা গ্রপ নামের প্রতিষ্ঠান। তবে হঠাৎ তাদের বাবা মারা যাওয়ার পর গ্রুপের মালিকানাধীন তালা মার্কা সাবান ও ভেজিটেবল অয়েলের সুনাম আর ধরে রাখতে পারেননি তারা। পরে জাহাজভাঙাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে আটটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর তা শোধ করেননি। উল্টো ওই টাকা নিয়ে ইসা বাদশা ও মুসা বাদশা এখন কানাডার টরেন্টোয় বাদশাহি-জীবন যাপন করছেন। টরেন্টোর লেকশোর এলাকায় তাদের দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বাড়ি ও নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের আটটি ব্যাংক ওই ৫০০ কোটি টাকা আদায়ে তাদের পেছনে ছুটে একরকম হয়রান, আদালতের খাতায় যারা এখন ‘ফেরারি’। সাবেক তত্ত্বাধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাবে এসব ঘটনা বারবার ঘটছে। পুরো আর্থিক খাতে একাট ঝাঁকুনি দরকার। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে যে, আর্থিক খাতে আর কোনো প্রতারণা বা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটবে না।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর