বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস ও বইমেলা

মারুফ রায়হান

ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস ও বইমেলা

ভালোবাসা দিবসকে এখন বাংলাদেশের তরুণ সমাজ বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করে। নানা ব্যক্তিগত আয়োজনে তারা দিনটিকে স্মৃতিময় করে রাখার চেষ্টা করে। একই সঙ্গে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্রে রেখে বহু বর্ণিল একটি বৃত্ত রচনা করে, যার সময়সীমা ১৪ ফেব্র“য়ারির ২৪ ঘণ্টাকে ছাপিয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। বলা অসঙ্গত হবে না যে, বিগত এক-দেড় দশকে আমাদের ভালোবাসা দিবস উদযাপনের বহুমাত্রিকতা তার পরিসর ও ওজন বিবেচনায় পৃথিবীর যে কোনো দেশকে ছুঁয়ে ফেলতে পারঙ্গম। আমাদের প্রেমিকরা বিশ্বের কোনো দেশের প্রেমিকের তুলনায় সামান্যতমও পিছিয়ে নেই। আর কে না জানে যে, প্রেমের কোনো বয়স নেই। আমি সত্তরোর্ধ্ব এমন ব্যক্তিকেও চিনি (নাম বা পেশা বলার কী দরকার!) যিনি এখনো প্রেমকাতর একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণের প্রতিযোগী হতে সক্ষম, প্রেমপ্রকাশ ও প্রেম উপাদান গ্রহণ উভয় ক্ষেত্রে। সত্যি বলতে কী, জীবনের একশ একটা যন্ত্রণার ভিতর সেঁধিয়ে থাকা মানুষের দেহমনে একটুখানি হলেও ভালোবাসার সুবাতাস এসে আছড়ে পড়ে এই দিন, হোক তা কয়েকটি মুহূর্তের জন্য। বড়ই বস্তুবাদী আর কাঠঠোকরার ঠোঁটের মতোই কঠিন ও জটিল স্যুটেড-ব্যুটেড ব্যক্তিও ভালোবাসার মন্দিরায় মনটাকে ভিজিয়ে ফেলার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। গৌরচন্দ্রিকা বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। এই বঙ্গে ফাগুন আর ভালোবাসা দিবস আসে হাত ধরাধরি করে। ভালোবাসা দিবসের বারতাই যেন এখন বাংলার ফাল্গুন আকাশে-বাতাসে, মাটিতে ও কংক্রিটে ছড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের বাংলা পঞ্জিকায় পয়লা ফাল্গুন হলো তেরোই ফেব্র“য়ারি আর ভ্যালেন্টাইন ডে ঠিক তার পরের দিন। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসে আছড়ে পড়ে ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসের ঢেউ। ভালোবাসা দিবসের রূপ-রস-গন্ধ-উত্তাপ রাজধানীর যে অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় তা হলো এ বইমেলা। বইমেলা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন প্রাঙ্গণ বাংলা একাডেমিতে না হতো তাহলে পয়লা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসে আমরা ভালোবাসার ওই সর্বব্যাপী রূপছটা থেকে অনেকখানি বঞ্চিত হতাম কিনা, সেটা বড় জিজ্ঞাসা। বইমেলা সত্যিই এক মুক্তাঞ্চল, তা যতই পুলিশ-মেটাল ডিটেক্টর-সিসিটিভি ক্যামেরার শ্যেনদৃষ্টি থাকুক না কেন। দলে দলে তরুণ-তরুণী বইমেলায় এসে উদযাপন করেন ভালোবাসা দিবস। মোল্লারা আর রক্ষণশীলরা চোখ কপালে তুলে রাখলেও তাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা পড়ে না। এক সময় প্রায় নিয়মিতভাবেই ভালোবাসা দিবসেও হরতাল ডাকা হয়েছে। তাতে কী। ভালোবাসার মানুষদের কেউ দমাতে পারেনি। বইমেলায় তার অপরূপ রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। ভালোবাসা দিবসের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি যে, এদিন অল্প বয়সী প্রেমিক-প্রেমিকারা পরস্পরকে নতুন বই উপহার দেওয়ার কথা বিবেচনা করেন। তাদের প্রথম পছন্দ কবিতার বই, প্রেমের কবিতার বই হলে তো সোনায় সোহাগা। এরপর তারা খোঁজেন প্রেমের উপন্যাস। এটা একেবারে নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। অনেক পন্ডিত লেখক আছেন যারা ভালোবাসা নিয়ে মাতামাতিকে বাঁকা নজরে দেখেন। যেন তারা কখনই কাউকে ভালোবাসেননি। আবার ভালোবাসা প্রসঙ্গে বাচাল হয়ে ওঠেনও কেউ কেউ। ভালোবাসা বিষয়টিকে অন্তরে গভীরভাবে ধারণ করে কোনো লেখক উচ্চারণ করতেই পারেন : প্রতিবার ভালোবেসে আমি হই শুদ্ধ সর্বহারা। ভালোবাসা দিবসে পুরুষ লেখককে কোনো অনুরাগী একগুচ্ছ লাল গোলাপ উপহার দেবেন এটা কামনা করি মনে মনে। কিন্তু পাঠিকারা লেখকের রচনাকে ভালোবাসেন, সেই রচনা তুলে দেন তার প্রেমিকের হাতে। লেখক এখানে হয়ে যান অনেকটা পিতা কিংবা শ্বশুরের মতো, নিদেনপক্ষে বড় ভাই। তবে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ থাকেন প্রায় ঈশ্বরের আসনে। ভালোবাসা দিবসের কদিন পরেই আসে জীবনানন্দের জন্মদিন। তাকে সেদিন নতুন করে প্রেম নিবেদন করেন জীবনপ্রেমিকরা। বিশেষ কোনো নারী বা পুরুষের জন্য প্রেম হয়তো একসময় ঘাস হয়ে আসতে পারে। কিন্তু নিজের জীবনের প্রতি প্রেম, বলা চাই, মহাজীবনের প্রতি প্রেম কখনো ফুরোয় না। তার নব নব অবয়ব তৈরি হয়, প্রকাশের রূপরেখা তৈরি হয়। তার একটি মাইলফলক কিংবা ফিরে তাকানোর দিন হয়ে উঠতে পারে আমাদের এই ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসা দিবসে তাই উচ্চারণ করেই বলি : বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ তোমাকে ভালোবাসি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর