বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা জয় করেই কর্মক্ষেত্রে পুলিশ

সাখাওয়াত কাওসার

৩০ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ট্রফিক-পূর্ব) ডেমরা জোনের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম। বাসায় ফিরলে পরিবারের অন্যরাও সংক্রমিত হতে পারেন এমন আশঙ্কায় সর্বক্ষণ অফিসেই অবস্থান করছেন। এখনো নেগেটিভ রিপোর্ট হাতে পাননি। তবে সুস্থ বোধ করায় কয়েক দিন ধরে এসি রবিউল তার অফিশিয়াল দায়িত্বও পালন করে যাচ্ছেন। করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কিন্তু নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পর কেউ কাজে যোগ দিয়েছেন কিনা- গতকাল বিকালে এমন প্রশ্নের জবাবে ওপরের তথ্যগুলো দেন ডিএমপির উপকমিশনার (ট্রাফিক-পূর্ব) মো. সাহেদ আল মাসুদ।

পরে কথা হয় এসি রবিউল ইসলামের সঙ্গে। দৃপ্তকণ্ঠেই তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছিলেন, ‘ভাই! আল্লাহ সুস্থ রেখেছেন এখনো। পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়ার পর একদিন রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে (সিপিএইচ) ভর্তি হয়েছিলাম। তবে পরদিন অফিসেই ফিরে এসে কোয়ারেন্টাইনে থাকি। সর্বক্ষণ চিকিৎসকের পরামর্শেই ছিলাম। আজ (মঙ্গলবার) নমুনা দিয়ে এসেছি। আশা করছি নেগেটিভ রিপোর্ট আসবে।’ ডিএমপির ট্রাফিক-পশ্চিম বিভাগের সহকারী উপপরিদর্শক মো. ফিরোজ কবীর। থাকেন ডিএমপির পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের (পিওএম) ট্রাফিক ব্যারাকে। গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। ১৩ এপ্রিল করোনা পজিটিভ হয়ে সিপিএইচে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে ২৮ তারিখ নেগেটিভ রিপোর্ট এলে কয়েক দিন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বিশ্রাম নেওয়ার পরই কাজে যোগ দিয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ফিরোজ কবীরের। তার কথায়ই বোঝা যাচ্ছিল কতটা শক্ত মনের অধিকারী তিনি। দৃপ্ত মনোবল নিয়ে এখনো দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বলছিলেন, ‘ভাই! আমরা জেনেশুনেই পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছি। রোগ সৃষ্টিকর্তার আদেশেই হয়। তবে আমি অসুস্থ থাকাকালে আমার সিনিয়র স্যারেরা সব সময় খোঁজখবর নিয়েছেন। মানসিক শক্তি জুগিয়েছেন।’ মঙ্গলবার পর্যন্ত নতুন করে ১২৮ জন নিয়ে সারা দেশে এ পর্যন্ত পুলিশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৪৯-এ। নয় পুলিশ সদস্য করোনার কাছে পরাজিত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। তবে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৪৩০ জন পুলিশ সদস্য। এই ৪৩০ জনের অনেকেই এরই মধ্যে তাদের কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। কাজে ফেরার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছেন অনেকেই। তাদেরই একজন করোনাজয়ী পুলিশ কনস্টেবল মুকুল মিয়া। কর্মরত ডিএমপির ট্রাফিক-পশ্চিম বিভাগে। তিনিও থাকেন পিওএম ব্যারাকে। তার উপলব্ধি হলো, ‘এখনো অনেকেই করোনা নিয়ে সচেতন নন। যার যার জায়গা থেকে আরও সচেতন থাকা দরকার। সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে ব্যারাকে ফিরে এসেছি। আবার কাজে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় আছি।’ এদিকে পুলিশ সদস্যদের পুলিশ লাইনস কিংবা ব্যারাকে থাকার পরিবেশ নিয়ে অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞই বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এই মহামারীর সময়ও পুলিশ সদস্যদের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত না করা এবং বিভিন্ন ব্যারাক ও ইউনিটের আবাসস্থলের দৃশ্য তাদের ভাবিয়ে তুলছে। তারা বলছেন, মানবিক পুলিশ হিসেবে নিজেদের জানান দিলেও কঠিন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালন এবং ব্যারাককেন্দ্রিক গাদাগাদি করে বসবাসের কারণে পুলিশ বাহিনীর প্রায় প্রতিটি সদস্যই করোনা সংক্রমণের তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘দেখুন, এই মহামারীতে অবশ্যই পুলিশ সদস্যদের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে। ব্যারাকে গাদাগাদি করে বসবাস করলে নিশ্চিত হওয়ার আগেই জীবাণু অনেকের শরীরে সংক্রমিত হয়ে যেতে পারে।’

তবে পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছিলেন, ‘আমরা পর্যায়ক্রমে সব ধরনের সুরক্ষা সুবিধা নিশ্চিতের চেষ্টা করছি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করা সদস্যের জন্যও আমরা এরই মধ্যে পুলিশের মনোগ্রাম-সংবলিত পিপিইসহ নানা ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করেছি। এখন পুলিশের উদ্যোগে তৈরি উন্নতমানের মাস্ক সরবরাহ করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘দেখুন, রাতারাতি সবকিছু পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তার পরও আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুসারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এরই মধ্যে করোনা আক্রান্ত ও কোয়ারেন্টাইনে থাকা সদস্যদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের জন্য বিভিন্ন ডরমেটরি এবং হোটেল, এমনকি হাসপাতাল ভাড়া করা হয়েছে। একই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় ডিউটি কমিয়ে মোবাইল ডিউটি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার পেশাগত দায়িত্বের বাইরে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা মানবিক বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।’

জানা গেছে, রাজারবাগ সিপিএইচ ছাড়াও ঢাকায় বেসরকারি ইমপালস হাসপাতাল, ট্রাফিক ব্যারাক চিকিৎসা কেন্দ্র ও রাজারবাগ স্কুল অ্যান্ড কলেজকে রিকভারি সেন্টার করা হয়েছে। উপসর্গ থাকা, এমনকি করোনা আক্রান্তদের সংস্পর্শে ছিলেন এমন পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন পুলিশ লাইনস থেকে সরিয়ে আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল, দিয়াবাড়ীতে প্রস্তাবিত পুলিশ লাইনসের অস্থায়ী ক্যাম্প, রায়েরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি, ডিবি ব্যারাকসহ ৩৫-৪০টি পৃথক জায়গায় রাখা হয়েছে। বিভাগীয় শহরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বেসরকারি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অসুস্থ পুলিশ সদস্যদের দেখাশোনার জন্য ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে ‘বিশেষ টিম’। ইউনিটগুলোর কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে আলাদা টিম গঠন করে পর্যায়ক্রমিকভাবে দায়িত্বে পাঠানো হচ্ছে। ৫০ বছরের বেশি বয়সের সদস্যদের খুব প্রয়োজন না হলে অফিসে/থানার বাইরে ডিউটিতে পাঠানো হচ্ছে না।

আরেক করোনাযোদ্ধা ডিএমপি ট্রফিক পূর্ব-বিভাগের ইন্সপেক্টর মোহা. হোসেন জাকারিয়া মেনন (৪৬)। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর। ৩০ এপ্রিল থেকে জ্বর এলে ৪ মে নমুনা পরীক্ষা করতে দেন। ৭ মে করোনা পজিটিভ জানার পর থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পল্লবীর ভাড়া বাসাতেই আইসোলেশনে রয়েছেন তিনি। বাসায় তার স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে। কবে কাজে যোগ দেবেন সেই দিন গুনছেন তিনি। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘কবে যে নেগেটিভ রিপোর্ট আসবে তার প্রতীক্ষায়। এর পরদিনই কাজে যোগ দিতে চাই। এত দিন বাসায় বসে থাকা যায়? প্রথম চার-পাঁচ দিন একটু সমস্যা হয়েছিল। তবে এর পর থেকে সুস্থ বোধ করছি। স্বামী পুলিশ হওয়ায় প্রতিকূলতা মোকাবিলা করার কারণে দিন দিন আমার স্ত্রীও অনেক সাহসী হয়ে উঠেছেন। সন্তানদের মনোবলও অনেক দৃঢ়।’

সিপিএইচে দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সান্তু। প্রতিমুহূর্তে দেখছেন করোনা আক্রান্ত কিংবা আইসোলেশনে থাকা পুলিশ সদস্যদের স্থানসংকুলান করতে কর্তৃপক্ষকে গলদঘর্ম হওয়ার চিত্র। তবে সার্বক্ষণিকভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামনে থেকে এই কর্মকর্তা অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার সমন্বয় টিমে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সুস্থ হয়ে ওঠা পুলিশ সদস্যদের হাসিমুখে ফুল দিয়ে বিদায় জানাচ্ছেন। গতকাল সন্ধ্যায় কথা হয় এই কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘ইমপালস্্ হাসপাতাল ভাড়া করার প্রথম দিনই পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এর আগে চিকিৎসার জন্য ব্যারাক, ডিটিএস, সিদ্ধেশ্বরী কলেজসহ অনেক খালি স্থাপনা আমরা ব্যবহার করে ফেলেছি। তাই সরকারের অর্থ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে সিপিএইচের নিকটবর্তী অব্যবহৃত কিংবা নতুন নির্মিত ভবন, যা এখনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি, তা সাময়িকভাবে ব্যবহারের সুবিধা পেলে সমস্যার অনেক লাঘব হতো।’

জানা গেছে, পুলিশের সদস্য সংখ্যা ২ লাখ ১২ হাজারের মধ্যে ডিএমপির ফোর্স প্রায় ৩৪ হাজার। এখন পর্যন্ত সারা দেশে করোনা আক্রান্তের মধ্যে অর্ধেকই হলো ডিএমপির সদস্য। আর পুলিশের মধ্যে যারা করোনায় আক্রান্ত তার মধ্যে অনেকেই বাহিনীর ট্রাফিক বিভাগ ও পরিবহন পুলের সদস্য।

পরিবহন পুলের সদস্য করোনা আক্রান্ত কনস্টেবল মনির হোসেন। পুলিশের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি। ৪ এপ্রিল ফোর্স নিয়ে দয়াগঞ্জ, মিলব্যারাক এলাকায় ডিউটিতে যান। ডিউটি শেষে বাসায় ফেরার পরই গলাব্যথা ও জ্বরে ভোগেন। ৮ এপ্রিল নমুনা দিয়ে ১১ এপ্রিল জানতে পারেন তিনি করোনা পজিটিভ। বর্তমানে সুস্থ হয়ে বাসায় বিশ্রামে আছেন। ডিএমপিতে এত বেশি আক্রান্ত কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (সদর দফতর) শাহ মিজান শাফিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের কাজের ধর্মই হলো মানুষের কাছে যাওয়া। চলমান এই মহামারীতে সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন বাস্তবায়ন ও আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে এর বিকল্প নেই। এর পরও পুলিশ সদস্যরা দমে যায়নি। পেশাগত দায়িত্বের বাইরে গিয়েও মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। যেখানে করোনা সন্দেহে লাশ রেখে তার স্বজনরা পালিয়েছে। লাশের গোসল করানো, দাফন/সৎকারের ব্যবস্থা করছে পুলিশ। অসুস্থ রোগীকে পুলিশের গাড়িতে করেই হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। অসহায় মানুষের খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। মাঠে থেকে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে বলেই পুলিশ সদস্যরা বেশি সংক্রমিত হচ্ছেন। তবু পিছু হটছেন না তারা।’

সর্বশেষ খবর