জনমনে কভিড আতঙ্ক কমে যাওয়ায় আবারও পুরোদমে শুরু হয়েছে কাজকর্ম। এর ফলে দেশের ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি (এসএমই) শিল্পের উদ্যোক্তারাও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এ খাতের জন্য সরকার-ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের খবরে উদ্যোক্তাদের জেঁকে বসা হতাশা অনেকটাই কেটে গেছে। টানা প্রায় ছয় মাস তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় অনেকেই পুঁজি হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছিলেন। তাদের অনেকেই সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পেয়েছেন। ফলে আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছেন অনেকেই। তবে এদের মধ্যে যারা ব্যাংক খাতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বা ব্যাংকে মর্টগেজ দেওয়ার মতো সক্ষমতা যাদের ছিল না, তারা প্রণোদনার কোনো সুবিধা পাননি। এদের সংখ্যাও কম নয়। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নিজ চেষ্টায় তারা আবার ব্যবসা চালু করছেন বলে জানা গেছে। এ জন্য প্রণোদনা প্যাকেজের বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যেত বলে মনে করেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
কেস স্টাডি-১ : কালার’স ক্রিয়েশন, দেশিক নামের একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী সাজিয়া সুলতানা। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে শুরু করেন এই বুটিক হাউসের ব্যবসা। পরবর্তী সময়ে সেটি অনলাইন শপ হিসেবেও বেশ জনপ্রিয়তা পায়। কয়েক বছরের ব্যবধানে বেশ লাভজনক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় কালারস ক্রিয়েশন। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে কভিড-১৯ মহামারী দেখা দিলে বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য। ব্যতিক্রম ছিল না কালার’র ক্রিয়েশনও। এতে গত চার মাসে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েন সাজিয়া সুলতানা। বর্তমানে কভিডের প্রভাব কমে আসায় তিনি আবার নতুন করে ব্যবসা শুরুর চেষ্টা করছেন। তবে তিনি প্রণোদনা প্যাকেজ বা ব্যাংকের কোনো সুবিধা পাননি। গত চার মাস কোনো ব্যবসা না হলেও প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছেন নিয়মিত। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে। কেননা মানুষের হাতে টাকা নেই। এ ছাড়া মানুষ একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য আবার নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, কভিডের প্রভাব অর্থনীতির সব খাতেই পড়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর প্রভাবও পড়েছে সমানভাবে। জনমনে আতঙ্ক কেটে যাওয়ায় মানুষ আবারও কর্মমুখী হয়েছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও খুলেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নানামুখী উদ্যোগও অনেকটা কাজে এসেছে। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারাও আবার নতুন করে জেগে উঠছেন। এর মধ্যে যারা পুঁজি হারিয়েছেন তারাও নতুন করে ব্যবসা চালুর চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ ব্যবসার ধরনও পরিবর্তন করছেন বলে তিনি মনে করেন। কেস স্টাডি-২ : এসএমই খাতের আরেক উদ্যোক্তা কেপিসি ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাজেদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রণোদনার অর্থ আমি পেয়েছি। ব্যবসাটা আবার নতুন করে সাজাচ্ছি। আশা করা যায় খুব দ্রুতই সবকিছু আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু অনেকেই এ সুবিধা পাননি। বিশেষ করে ব্যাংকের সঙ্গে যাদের লেনদেন নেই। কিংবা মর্টগেজ দেওয়ার মতো সক্ষমতা নেই এমন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এ প্রণোদনার সুবিধা পাননি। ফলে তাদের মধ্যে এখনো কিছুটা হতাশা রয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত গাইডলাইনে কিছুটা সংশোধনী আনা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। জানা গেছে, এ বছর দুটি ঈদ আর একটি নববর্ষ গেছে বাণিজ্যহীন। যে উৎসবগুলোকে ঘিরে এসএমই খাতের উদ্যাক্তাদের বেচাকেনা বেশি হয়ে থাকে সেটি এবার হয়নি। ফলে অনেক উদ্যোক্তাই তাদের পুঁজি হারিয়েছেন। এখন আবার তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এদিকে এসএমএই ও এমএসএমই খাতের সুরক্ষায় সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ হাজার কোটি টাকার একটি ঘূর্ণায়মান তহবিল গঠন করেছে। কিন্তু এর সুুবিধা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান দেশে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার সংখ্যা সাড়ে ৫ লাখ, ছোট উদ্যোক্তা ৬৬ লাখ এবং মাঝারি উদ্যোক্তা ৭ লাখ। এতে মোট ৭৮ লাখ ৫০ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা এ খাতে। আর শুধু ছোট শিল্পপ্রতিষ্ঠানেই কর্মরত আছেন প্রায় ৬০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী। এর বাইরে কুটির, মাাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কারখানার মালিক, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজসহ এসব খাতে প্রায় এক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। টানা অচলাবস্থার মধ্যে এ সবকিছুই হুমকির মুখে পড়েছিল। এখন আবার সবকিছুই সচল হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, কভিডের প্রভাবে সারা পৃথিবীতেই জনজীবন থেমে যায়। থমকে যায় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য। আমাদের এখানেও এর প্রভাব পড়ে। সরকার নানামুখী উদ্যোগ নেওয়ায় সবাই এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, সারা দেশে মাত্র ১০ হাজার মাঝারি উদ্যোক্তা রয়েছেন, যারা ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত। এরাই প্রণোদনার সুবিধাটা পাচ্ছেন। অথচ সারা দেশে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রয়েছেন ৭৮ লাখ, যারা ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত নন। ফলে তারা এই প্রণোদনার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ এরাই কিন্তু অর্থনীতির বড় একটা অংশ। প্রায় ২৫ শতাংশ তারাই জোগান দেন। এরা কিন্তু নিজেরাই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এ জন্য এদের রক্ষা করতে হলে আমাদের একটা বিকল্প উত্তরণ পদ্ধতি বের করতে হবে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিসিকসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একত্রে বসে একটা সমাধানে যেতে হবে।
জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগ ছিল ১০ লাখ ৫৩ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ১৯ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা ছিল এসএমই খাতে। এসএমই খাতে মোট ঋণের ৭৬ দশমিক ৬৬ শতাংশই বিতরণ করেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এসএমই খাতে ঋণ দিয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১১৩ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৩৭ হাজার ৬৫৩ কোটি, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ১ হাজার ৭১০ কোটি এবং বিদেশি ব্যাংকগুলো ২ হাজার ১০৩ কোটি টাকা এসএমই খাতে বিনিয়োগ করেছে। এ ছাড়া এসএমই খাতে ১০ হাজার ১১৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে দেশে কার্যরত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)।এদিকে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এপ্রিল-মে মাসে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যই ছিল নেতিবাচক। এ সময় এসএমই খাতসহ সব খাতই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জুন ও জুলাই মাসে আবার সবাই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। কেননা এ সময়ের কভিড-১৯ আতঙ্ক অনেকটাই কমে এসেছে। অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, সরকার ইতিমধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, সে-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা আছে, ঋণ বিতরণকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বিতরণকৃত ঋণের পাঁচ ভাগ নারীদের দেবে। অর্থাৎ সরকার-ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ পুরো বাস্তবায়িত হলে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা নারী উদ্যোক্তাদের পাওয়ার কথা। এ তথ্যটি অনেক নারী উদ্যোক্তাই অবগত নন। এ ব্যাপারে প্রচারণা চালাতে হবে এবং যেসব ব্যাংক ঋণ প্রদান করার দায়িত্ব পেয়েছে, তাদের কাছ থেকে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের সুবিধা নিতে হবে। বর্তমান সংকটকালে আরেকটি জিনিস স্পষ্টভাবে অনুভূত হয়েছে। তা হলো নেটওয়ার্কিংয়ের গুরুত্ব। যে নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে অন্যান্য উদ্যোক্তা, বিভিন্ন পেশাজীবী ও ভোক্তাদের সম্পর্ক যত নিবিড়, তিনি তার ব্যবসা ততটা চালু রাখতে পেরেছেন। ইতিমধ্যে অনেকে নতুন উদ্যমে বাণিজ্যিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।