শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সরকারি বাসায় ইউএনওকে হত্যার চেষ্টা

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে বাবা জখম

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও দিনাজপুর প্রতিনিধি

সরকারি বাসায় ইউএনওকে হত্যার চেষ্টা

গুরুতর আহত ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হচ্ছে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের সরকারি বাসভবনে ঢুকে হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রাতের আঁধারে ভেনটিলেটর ভেঙে ভিতরে ঢুকেই বেডরুমে হাতুড়ি দিয়ে ওয়াহিদা খানমের ওপর এলোপাতাড়ি আঘাত করে তারা। মেয়ের চিৎকারে পাশের কক্ষ থেকে বৃদ্ধ বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখ (৭০) ছুটে এলে তাকেও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হেলিকপ্টারে করে ওয়াহিদা খানমকে ঢাকায় এনে ভর্তি করা হয় আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে। চিকিৎসকরা জানান, তার মাথার খুলি ভেঙে ব্রেনে ঢুকে গেছে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এখন তিনি। তার চিকিৎসায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শক্তিশালী মেডিকেল টিম গঠন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে তার চিকিৎসার তদারকি করা হচ্ছে। ওয়াহিদা খানমের স্বামী রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন পীরগঞ্জে। গতকাল রাতেই তার অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বুধবার দিবাগত মধ্যরাতে বাসার পেছন দিকে মই দিয়ে উঠে দুর্বৃত্তরা ভেনটিলেটর ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে। হাতুড়ি জাতীয় ভারী বস্তু নিয়ে তারা প্রথমেই ঢুকে যায় ওয়াহিদা খানমের শয়নকক্ষে। সেখানে তারা অতর্কিত হামলা চালায় ওয়াহিদা খানমের ওপর। মেয়ের চিৎকারে পাশের কক্ষে থাকা বৃদ্ধ বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখ (৭০) ছুটে এলে তাকেও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়। এর আগে বাসভবনের প্রহরীকে একটি ঘরে আটকে রাখে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ ঘটনার সময়ের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। তাতে দেখা যায়, হামলায় জড়িত দুই দুর্বৃত্ত ছিল মাস্ক পরা। তাদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। গুরুতর আহত অবস্থায় ওয়াহিদা খানম ও তার বাবাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে দুপুরে হেলিকপ্টারে করে ওয়াহিদা বেগমকে ঢাকায় আনা হয়। বুধবার দিবাগত মধ্যরাতে এই ভয়ঙ্কর হামলার ঘটনাটি ঘটলেও জানাজানি হয় গতকাল ভোরে। পুলিশ ওই বাসায় গিয়ে রক্তাক্ত ওয়াহিদা খানম এবং তার বাবাকে উদ্ধার করে। তারা এ সময় অচেতন ছিলেন। বাসায় ওয়াহিদা বেগমের তিন বছরের শিশুসন্তান ছিল ঘুমে। পুলিশ ও গোয়েন্দারা জানান, নিশ্চিত হত্যার উদ্দেশ্যেই এ হামলা চালানো হয়েছে। ডাকাতির ঘটনা এটি নয়। কোনো কিছু খোয়া যায়নি বাসা থেকে।  সংবাদ শুনে সকালে দিনাজপুর-৬ আসনের এমপি শিবলী সাদিক, জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল আলম ও পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এমপি শিবলী সাদিক বলেন, ‘এটি কোনো ডাকাতির ঘটনা নয়। কারণ ঘরের কোনো মালামাল খোয়া যায়নি। তাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে আমার ধারণা।’ তিনি বলেন, এ উপজেলায় বড় কোনো শিল্প-কারখানা নেই। অধিকাংশই কৃষক। স্থানীয়ভাবে তার শত্রু থাকার কথা নয়। ইউএনওর বাড়ি নাটোর জেলায় এবং শ্বশুরবাড়ি নওগাঁ জেলায়।

এদিকে দুর্বৃত্তের হামলায় আহত ইউএনও ওয়াহিদা খানমের অবস্থা যথেষ্ট সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের চিকিৎসকরা। তাকে গতকাল বেলা ৩টার দিকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অস্ত্রোপচার কক্ষে নিয়ে গেলেও অস্ত্রোপচার করার মতো পরিস্থিতিতে তিনি নেই বলে চিকিৎসকরা জানান। হাসপাতালের পরিচালক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ বলেন, ইউএনওর মাথার আঘাত অনেক জটিল ও গুরুতর। প্রাথমিকভাবে তাকে দেখা হয়েছে। সবকিছু বিবেচনা করে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক জাহেদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউএনওর মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। মাথার খুলির হাড় ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেছে। এটি মস্তিষ্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে প্রচন্ডভাবে। ভিতরে রক্তরক্ষণ হয়েছে। তার অবস্থা স্থিতিশীল নয়। ব্লাডপ্রেশার কমে গেছে। জ্ঞানের মাত্রা সাধারণ মানুষের মতো নেই, যদিও তিনি কথাবার্তা বলার চেষ্টা করছেন। তিনি প্রেশার ধরে রাখতে পারছেন না। প্রেশার কমে যাচ্ছে। তার পালস বেড়ে গেছে। তিনি রেস্টলেস অবস্থায় আছেন। আগে তাকে স্ট্যাবল (স্থিতিশীল অবস্থা) করতে হবে। অপারেশন (অস্ত্রোপচার) করার মতো অবস্থা নেই। এখন অপারেশন করলে বিপজ্জনক হবে। আগে তার অবস্থার উন্নতি করাতে হবে। ব্লাড, স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। অনেকগুলো ওষুধ দেওয়া হয়েছে।’

ইউএনও কেমন শঙ্কায় আছেন- এমন প্রশ্নে অধ্যাপক জাহেদ হোসেন বলেন, ‘শঙ্কাটা কতটুকু বলা কঠিন। তবে তিনি সংকটাপন্ন অবস্থাতেই আছেন। তার ব্লাডপ্রেশার, পালস রেট ও জ্ঞানের মাত্রার অবস্থার উন্নতি না হলে তিনি যথেষ্ট বিপজ্জনক অবস্থায় আছেন। যে কোনো সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটেও যেতে পারে।’ পরে ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে অস্ত্রোপচারের জন্য রাত ৯টায় অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। রাত ১১টা ০৫ মিনিটে তার অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসকরা বলেছেন, ওয়াহিদা খানমের পরিস্থিতি ভালো নয়। ইউএনওর চিকিৎসায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি মেডিকেল টিম গঠন করেছে। এ দলে আছেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ, নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক জাহেদ হোসেন, হাসপাতালের যুগ্ম-পরিচালক বদরুল আলম, চিকিৎসক এম এম জহিরুল হক, চিকিৎসক আমিন মোহাম্মদ খান, চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান ও চিকিৎসক উজ্জ্বল কুমার মল্লিক। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই ইউএনওর শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে সাংবাদিকদের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, বাসার সামনের সিসিটিভি ফুটেজে হালকা গড়নের কম বয়সী দুজনকে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। তবে তাদের চেহারা অস্পষ্ট, চেনা যাচ্ছে না। তারা ইউএনওকে হাতুড়ি জাতীয় কিছু দিয়ে আঘাত করেছে বলে মনে হচ্ছে। জড়িতদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘স্থানীয় পুলিশ সুপার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। আশা করছি, খুব দ্রুত হামলাকারীদের গ্রেফতার সম্ভব হবে। চিকিৎসাধীন ওয়াহিদা খানমের সেন্স আছে এবং স্পষ্ট কথা বলতে পারছেন। তিনি হামলাকারী কাউকে চেনেন না বলে জানিয়েছেন। তার ভাষ্যমতে, কারও সঙ্গে কোনো ধরনের শত্রুতা ছিল না। এর আগে ইউএনও ও তার বাবাকে গুরুতর আহত অবস্থায় গতকাল ভোরে প্রথমে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে নেওয়া হয় রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। উন্নত চিকিৎসার জন্য সেখান থেকে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তোফায়েল হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ইউএনওর মাথার বাঁ-দিকে বেশি আঘাত লেগেছে। তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তার শরীরের ডান দিক অবশ হয়ে গেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক। ইউএনওর বাবা ওমর আলী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৯ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন। তার মাথা ও শরীরে ধাতব বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় বলেন, ‘আমি ভোর সাড়ে ৪টার দিকে নামাজ আদায় করতে উঠে পাশের ঘর থেকে মেয়ের চিৎকার শুনতে পাই। সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করলে একজন মুখে কাপড় বাঁধা অবস্থায় এসে আমাকে ভয় দেখিয়ে আলমারির চাবি চায়। বলে, না দিলে মেরে ফেলা হবে। এরপর হাতুড়ি দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করলে আমি লুটিয়ে পড়ি। এরপর আর কিছু বলতে পারি না।’ ইউএনওর বাবা আরও বলেন, ‘ঘোড়াঘাটে মেয়ে একা থাকে। জামাতা রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ইউএনও। মেয়ের সঙ্গে তিন বছর বয়সী নাতি থাকে। এই উপজেলায় আড়াই বছর ধরে মেয়ের সঙ্গে থাকছি। মাঝে-মধ্যে মহাদেবপুরের বাড়িতে যাই। আমি মেয়ের সঙ্গে থাকা অবস্থায় মেয়েকে কেউ কোনো হুমকি দিয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই।’ ঘোড়াঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিরুল ইসলাম জানান, সিসিটিভির ফুটেজে হামলার সঙ্গে দুজনকে জড়িত থাকতে দেখা গেছে। তারা দুজনই মুখে মাস্ক পরে ছিল। মই বেয়ে ভেনটিলেটর দিয়ে একজন প্রবেশ করে। সেই কক্ষে সে অবস্থান করেছিল বলেও ফুটেজে দেখা গেছে। ইউএনওর ভাই ফরিদুল ইসলাম অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে সন্ধ্যায় থানায় মামলা করেছেন বলে জানান ওসি। এ ঘটনায় এখনো কেউ গ্রেফতার হয়নি। তবে এখানে র‌্যাব, পুলিশ, সিআইডি, ডিবির দল তদন্ত করছে। ওসি বলেন, রাতে ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখ ঘোড়াঘাট উপজেলার ‘শাপলা’ নামক সরকারি বাসভবনে ঘুমিয়ে ছিলেন। বুধবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে তার সরকারি বাসভবনের পেছনে দোতলার বাথরুমের ভেনটিলেটর ভেঙে দুর্বৃত্তরা ঘরে প্রবেশ করে। এ কাজে তারা ব্যবহার করে একটি মই। বাড়ির পেছনে মইটি পাওয়া যায়। তিনি জানান, প্রথমে নির্বাহী কর্মকর্তার বাবাকে আহত করে বাথরুমে আটকিয়ে রাখে দুর্বৃত্তরা। এরপর নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমকে হাতুড়ি দিয়ে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে অন্য কোয়ার্টারের বাসিন্দারা টের পেয়ে পুলিশকে খবর দেন। তার সরকারি বাসভবনের নাইটগার্ড পলাশকে ঘরে তালা দিয়ে আটকে রাখে দুর্বৃত্তরা। কাজের মেয়ে নিচের তলায় ছিল। দুষ্কৃৃতকারীরা দুই-তিনজন হতে পারে। তবে পুলিশের ধারণা, হত্যার উদ্দেশ্যে ওয়াহিদা খানমকে আঘাত করা হয়। এটি কোনো ডাকাতি ছিল না। সম্ভবত হত্যার উদ্দেশ্যেই এ হামলা হয়েছে বলে মনে করেন পুলিশের এ কর্মকর্তা। জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পলাশকে আটক করা হয়েছে। এদিকে নিজস্ব প্রতিবেদক রাজশাহী জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানম এবং তার বাবা রাজশাহীর বাগমারার মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখের ওপর দুর্বৃত্তদের নৃশংস হামলার ঘটনায় হতবাক তার পরিবার ও বাগমারা গ্রামবাসী। আহত মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখের ভাই বাগমারা ভোকেশনাল স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট মজিবর রহমান তার ভাই ও ভাতিজির ওপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

অন্যদিকে ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখের ওপর হামলার ঘটনায় রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন রংপুর পুলিশের ডিআইজির একজন প্রতিনিধি এবং দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আসিফ মাহমুদ। দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবু সালেহ মো. মাহফুজুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর