মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

বড় প্রকল্পে করোনার ধাক্কা

কাজ শেষ হচ্ছে না নির্ধারিত সময়ে, বাড়ছে ব্যয়, পাইপলাইনে থাকা প্রকল্পগুলোর কাজও শুরু হচ্ছে না নির্দিষ্ট সময়ে

মানিক মুনতাসির

বড় প্রকল্পে করোনার ধাক্কা

২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের পরপরই সারা দেশে শুরু হয় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড। দ্বিতীয় মেয়াদেও সরকার অপরিবর্তিত থাকায় সে উন্নয়ন কর্মকান্ড আরও গতি পায়। ঢাকাসহ সারা দেশের রাস্তাঘাট, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় শুরু হয় ধাবমান ঘোড়ার মতো উন্নয়ন কর্মকান্ড। দীর্ঘদিনের বাধা কাটিয়ে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে আসে অবিশ্বাস্য সাফল্য। এরই ধারাবাহিকতায় একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও টানা তৃতীয়বার জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

এর আগে দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, রেলসহ সংশ্লিষ্ট খাতগুলোয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বৃহৎ প্রায় এক ডজন প্রকল্পের কাজ শুরু করে সরকার। এগিয়েও যাচ্ছিল বেশ দ্রুত গতিতে। তরতর করে বাড়তে থাকে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ও জিডিপি। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে সারা বিশ্বে শুরু হয় কভিড-১৯ মহামারী। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নেমে আসে বিপর্যয়। থেমে যায় সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড। বছরের প্রায় শেষ প্রান্তে এসেও থামেনি প্রাণঘাতী কভিড-১৯-এর অচলাবস্থা। ফলে সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড প্রায় থেমে গেছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দু-একটি প্রকল্পের কাজ চললেও সেগুলোতে নেই কাক্সিক্ষত গতি। জানা গেছে, চলমান কভিড-১৯ মহামারীর আঘাতে সারা দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে বিরাজ করছে স্থবিরতা। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৩১তম স্প্যান বসানোর চার মাস পর ১১ অক্টোবর বসানো হয়েছে ৩২তম স্প্যান। অবশ্য মাত্র আট দিনের ব্যবধানে ৩৩তম স্প্যানটি বসানো হয়েছে গতকাল। এর ফলে এখন পদ্মা সেতুর ৫ কিলোমিটার দৃশ্যমান। কিন্তু গত পাঁচ মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ যতটা পিছিয়েছে তা পুষিয়ে নিতে তার চেয়েও বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটসহ চলমান কোনো বৃহৎ প্রকল্পই শেষ হচ্ছে না নির্ধারিত সময়ে। এর ফলে বাড়ছে প্রকল্প ব্যয়। পাইপলাইনে থাকা প্রকল্পগুলোর কাজও শুরু হচ্ছে না নির্দিষ্ট সময়ে। এদিকে বহুল প্রত্যাশিত ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে হাইস্পিড রেল স্থাপন প্রকল্পের কাজ পেছাচ্ছে বারবার। দুই বছর পেছানো হয়েছে বঙ্গবন্ধু রেলসেতু নির্মাণের সময়সীমা। যদিও বলা হচ্ছে আগামী মাসে এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পিছিয়েছে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন টানেলের কাজও। এ প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৯ শতাংশ, যা হওয়ার কথা ছিল ৭০ শতাংশ। তবে এখন পুরোদমে চলছে এ প্রকল্পের কাজ। ফলে আশা করা হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পগুলোর কাজও চলছে না কাক্সিক্ষত গতিতে। অর্থায়নে তেমন কোনো সংকট না থাকলেও সামগ্রিক প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজই থেমে গেছে। গ্রামাঞ্চলের রাস্তাঘাট সংস্কারের কাজও চলছে ধীরগতিতে। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘করোনার আঘাতে আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবে সেটাকে খুব ভালোভাবেই সামাল দিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে সামষ্টিক অর্থনীতি।’ তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হতে সময় বেশি লাগার জন্য পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রল্পের মূল সেতু ও নদীশাসন তদারকির জন্য পরামর্শক সংস্থার মেয়াদ আরও ৩৪ মাস বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এজন্য সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে ৩৪৮ কোটি ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা। বিভিন্ন কারণে বিশেষ করে বর্তমানে করোনা সংক্রমণের কারণে পদ্মা সেতুর কাজ সময়মতো করতে পারিনি। এ ছাড়া করোনার পাশাপাশি চলতি বছর যে ভয়াবহ বন্যা, যা কখনো কল্পনা করিনি। এ বন্যার কারণেও কাজ বন্ধ ছিল। এর ফলে পদ্মা সেতুসহ সার্বিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এখন অবশ্য ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে।’

যদিও সেতু কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, গত সেপ্টম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ইতিমধ্যে ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ১৯ শতাংশ। তবে প্রথম ধাপের অগ্রগতি হয়েছে ৫৭ শতাংশ। চলতি বছরের শুরুতে প্রায় চার মাস খুবই ধীরগতিতে এগিয়েছে এসব প্রকল্পের কাজ।

বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩২ শতাংশেরও কম। এ প্রকল্পের মেয়াদ জুন, ২০২২ পর্যন্ত বৃদ্ধির বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন পাওয়া গেছে এবং ডিসেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত বৃদ্ধির বিষয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অনুমোদন পাওয়া গেছে। এ ছাড়া প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধনের বিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে বলে সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। পিছিয়েছে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের নির্মাণকাজও।

এদিকে ঢাকা শহরে সাবওয়ে নির্মাণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হলেও কাজ শুরুর দিনক্ষণ পিছিয়েছে। এ প্রকল্পের চূড়ান্ত সমীক্ষাসংক্রান্ত কাজের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০ শতাংশ। প্রকল্পের রুট অ্যালাইনমেন্ট বরাবর সাবওয়ে সয়েল ইনভেস্টিগেশন কাজ চলমান। যার অগ্রগতি ৯০ শতাংশ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজেও নেই কাক্সিক্ষত গতি।

সেতু বিভাগের চলমান প্রকল্প তালিকায় থাকা আরও ৬টি প্রকল্পের কাজও পিছিয়েছে। এর মধ্যে ৫টি সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলমান। এগুলো হলো- পটুয়াখালী-আমতলী-বরগুনা-কাকচিড়া সড়কে (জ-৮৮০) পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ, বাকেরগঞ্জ-বাউফল উপজেলা সড়কে কারখানা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ, বরিশাল-ভোলা সড়কে তেঁতুলিয়া ও কালাবাদর নদের ওপর সেতু নির্মাণ, ভুলতা-আড়াইহাজার-বাঞ্ছারামপুর সড়কে (জ-২০৩) মেঘনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ। এ ছাড়া এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ চলছে ধীরগতিতে। ফলে এসব প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে না পারলে বাড়বে প্রকল্প ব্যয়ও।

জানা গেছে, গত ১১ অক্টোবর বহুমুখী সেতুটির ৪ ও ৫ নম্বর খুঁটির ওপর স্থাপন করা হয় ৩২তম স্প্যান। ৩১তম স্প্যান বসানোর চার মাস পর এ স্প্যানটি বসানো হয়েছিল। এবার মাত্র আট দিন পর বসানো হলো ৩৩তম স্প্যান। গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ৫টি স্প্যান খুঁটির ওপর বসানোর লক্ষ্য ছিল। তবে মাওয়া প্রান্তের মূল পদ্মায় প্রচ- স্রোত থাকায় ১টি স্প্যানও বসানো সম্ভব হয়নি। এখন পদ্মায় বন্যার পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্রোতের তীব্রতাও স্বাভাবিক গতিতে ফিরেছে। ফলে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে কিছুটা গতি ফিরেছে। তবে ২০২২ সালের আগে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে না। এ ছাড়া পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্পের কাজ একই সময়ে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তার কোনো সম্ভাবনা এখন আর নেই।

এদিকে প্রায় চার মাসের ধীরগতির পর মেট্রোরেল লাইন-৬, কর্ণফুলী টানেল, বিআরটি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজে গতি কিছুটা বেড়েছে। সম্প্রতি ফার্স্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলোর তদারকিসংক্রান্ত টাস্কফোর্সের এক সভায় এসব প্রকল্পের কাজের গতি বাড়ানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেট্রোরেল লাইন-৬-এর কাজে অনেকটাই গতি ফিরেছে। প্রকল্প এলাকায় প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা কাজ করছেন দিনরাত। এ প্রকল্পের কাজের অগ্রগতিসংক্রান্ত মাসিক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, গত মার্চে কাজের সার্বিক অগ্রগতি ছিল ৪৪ দশমিক ১২ শতাংশ। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে ৭০ দশমিক ৫৪ ও আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের অগ্রগতি ছিল ৩৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর ছয় মাস পর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৫০ দশমিক ৪০ শতাংশ। সে হিসাবে ছয় মাসে কাজ এগিয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। এ সময় পর্যন্ত উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের কাজের মোট অগ্রগতি ৭৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আগারগাঁও থেকে মতিঝিলে অগ্রগতি হয়েছে ৪৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। মেট্রোরেল প্রকল্পে কমবেশি ১০ হাজার কর্মী কাজ করেন। এর মধ্যে ১ হাজারের মতো বিদেশি নাগরিক কর্মরত আছেন। এতে জাপান, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আছেন। বর্তমানে ৬০০ জনের মতো বিদেশি নাগরিক এ প্রকল্পে কাজ করছেন। বাকিরা ছুটিতে গিয়ে আর কাজে ফিরতে পারেননি কভিড-১৯-এর কারণে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে ২০১৯ সালে মেট্রোরেল চালুর ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। পরে দুই বছর বাড়ানো হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কোম্পানি ডিএমটিসিএল-সূত্র বলছেন, আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের কাজ পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব। কিন্তু মতিঝিল পর্যন্ত কাজ শেষ হতে আরও দুই বছর লেগে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর