বুধবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

কাউন্সিলর ইরফান সেলিম বরখাস্ত

অস্ত্র ও মাদক আইনে দুই মামলা, সহকারী রিমান্ডে, কারাগারে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন, অগ্রণী ব্যাংকের জমি উদ্ধার

নিজস্ব প্রতিবেদক

কাউন্সিলর ইরফান সেলিম বরখাস্ত

ইরফান সেলিমকে বরখাস্ত করা হয়েছে কাউন্সিলর পদ থেকে। তার সহকারীকে গতকাল রিমান্ডে নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী -বাংলাদেশ প্রতিদিন

নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীর ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেফতার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইরফান সেলিমকে সে পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

গতকাল স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব আ ন ম ফয়জুল হক স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ আদেশ জারি করা হয়। অন্যদিকে, ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে অস্ত্রসহ আরও মামলা হবে বলে জানিয়েছেন র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ইরফান ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ছেলে। কারাগারে থাকা ইরফান ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন এবং তার সহকারী এ বি সিদ্দিক ওরফে তপুকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

বরখাস্তের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ইরফান সেলিমকে বিদেশি মদ সেবন করায় ভ্রাম্যমাণ আদালত এক বছরের কারাদন্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদন্ড দিয়ে জেলহাজতে প্রেরণ করে। এ ছাড়া অবৈধ ওয়াকিটকি রাখা ও ব্যবহারের দায়ে তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালত আরও ছয় মাসের কারাদন্ড দেয়। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক রাখার দায়ে আরও মামলার কার্যক্রম চলমান। ফলে তিনি সিটি করপোরেশনের আইন অনুযায়ী অপরাধ করেছেন। সিটি করপোরেশনের কোনো কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ এবং অসদাচরণের অভিযোগে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন অনুযায়ী অভিযুক্ত কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইরফান সেলিমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

এর আগে গতকাল সকালে সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, ইরফান সেলিমকে আইনানুযায়ী মঙ্গলবারই কাউন্সিলর পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে। একই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে তাকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে খুব গুরুত্বের সঙ্গে আইনের শাসনে বিশ্বাস করেন। অপরাধীর পরিচয় যাই হোক না কেন অপরাধ করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। অপরাধী কোন দলের, কোন পদবিধারী এটা বিবেচনায় আনা হবে না।

অগ্রণী ব্যাংকের জমি উদ্ধার : আদালতে মামলা এবং দফায় দফায় র‌্যাব-পুলিশকে অবহিত করে কোনো কাজ না হলেও এবার বিনা বাধায় সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের দখলে থাকা পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার এলাকার জমি নিজেদের দখলে নিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। গতকাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা ছাড়াই ব্যাংকের কর্মকর্তারা হাজী সেলিমের দেওয়া সীমানা প্রাচীর ভেঙে ব্যাংকের জমি বুঝে নিয়েছেন। গতকাল মৌলভীবাজারে উপস্থিত ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মৌলভীবাজার এলাকায় ১৪ শতাংশ জমির ওপর একটি দোতলা ভবন ছিল। স্বাধীনতার পর নির্মিত ভবনটি অনেক পুরনো হওয়ায় কিছু দিন আগে নতুন ভবনে শাখা স্থানান্তর করা হয়েছে। এরপর থেকে তা ইরফান গংদের দখলে ছিল। কোনোভাবেই জমিটি নিজেদের কব্জায় নিতে পারছিল না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এর আগে গত ২০ মে ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক বৈষ্ণব দাস মন্ডল বাদী হয়ে চকবাজার থানায় প্রথমে সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর-৫৯৯) করেন। পরবর্তীতে ১৫ জুন র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক বরাবর চিঠি দিয়ে সহায়তা চান। এরপরও ইরফান গংদের কিছুই করা সম্ভব হচ্ছিল না। ব্যাংকের কর্মকর্তা মেজর (অব.) আসাদুজ্জামান জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ব্যাংকের শাখাটিও বন্ধ ছিল। এখানে দায়িত্বরত নিরাপত্তা প্রহরী ভল্ট পাহারা দিতে ভিতরে অবস্থান করে। সেই সুযোগে চলতি বছরের মে মাসে আমাদের পুরনো ভবনটি গুঁড়িয়ে দিয়ে জমি দখলে নেয় দুর্বৃত্তরা। আজ আমরা সীমানা প্রাচীরের গেটের তালা ভেঙে তা দখলে নিয়েছি। পুরনো ভবনে ব্যাংকের অনেক সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল বলে জানান তিনি।

একাধিক সূত্র বলছে, কাউন্সিলর হলেও সংসদ সদস্য বাবার স্টিকার ব্যক্তিগত গাড়িতে ব্যবহার করে চলতেন ইরফান সেলিম। নিয়মিত সাইরেন বাজিয়ে এলাকায় চলাফেরা করতেন হাজী সেলিমপুত্র। সঙ্গে থাকত দেহরক্ষী এবং একাধিক গাড়ির বহর। ইরফান এলাকায় ঢুকলেই তার ভয়ে তটস্থ থাকত সাধারণ মানুষ। চলাচলে বাধা পেলে তার সঙ্গে থাকা সেলিম বাবু, জাহিদ ও দীপুসহ অন্তত সাতজনের একটি টিম যাকে-তাকে মারধর করত। ক্ষমতা আর অর্থের দম্ভে মানুষকে মানুষ ভাবারও সময় ছিল না ইরফানদের। নিজের বাসা ও অফিসকেও তিনি তৈরি করেছেন অনেকটা দুর্গের মতো করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করে এমন ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফ, ফ্রিকোয়েন্সি ডিভাইস ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ করতেন চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। মানুষকে ধরে এনে নির্যাতনের জন্য সেখানে গড়েছিলেন টর্চারসেল।

কারাগারে কোয়ারেন্টাইনে ইরফান : গত সোমবার রাতে গ্রেফতারের পর মঙ্গলবার গভীর রাতে ইরফান এবং তার দেহরক্ষী জাহিদকে র‌্যাব হেফাজত থেকে কারাগারে পাঠানো হয়। তার আগে মদ্যপান ও ওয়াকিটকি ব্যবহার করার অপরাধে তাকে সাজা দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ বিষয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ইরফান কারাগারে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। করোনাভাইরাস মহামারীকালে কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো নতুন বন্দীকে একটি সেলে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়।

অস্ত্র ও মাদক মামলা : র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল দুপুরে টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বলেছেন, ইতিমধ্যে মাদক মামলায় ইরফান সেলিমকে সাজা প্রদান করা হয়েছে। অস্ত্র, মাদক, ইলেকট্রিক ডিভাইসসহ বিভিন্ন মালামাল পাওয়া যায় তার বাসায়। এসব বিষয়েও তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। কাউন্সিলর ইরফান সেলিমের নিয়মিত মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তার বাসা থেকে অস্ত্রসহ বিভিন্ন মালামাল পাওয়া যায়।

পরে রাত ৯টার দিকে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রকিবুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইরফানকে  সোমবার দিবাগত রাত দেড়টার পর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে চকবাজার থানায় দুটি মামলা হবে রাতে। এরই মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

তিন দিনের রিমান্ডে সেলিমের ব্যক্তিগত সহকারী দীপু : ইরফান সেলিমের ব্যক্তিগত সহকারী এ বি সিদ্দিক দীপুকে গতকাল গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে টাঙ্গাইল শহর থেকে এ বি সিদ্দিক দীপুকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। দীপুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। আদালত শুনানি শেষে তার জামিন আবেদন খারিজ করে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। সোমবার ঢাকা মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদারের আদালতে এই আদেশ হয়।

এর আগে গত সোমবার সকালে ইরফান সেলিম, তার বডিগার্ড  মোহাম্মদ জাহিদ, এ বি সিদ্দিক দীপু এবং গাড়িচালক মিজানুর রহমানসহ অজ্ঞাত দু-তিনজনকে আসামি করে নৌ বাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহম্মেদ খান বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন। সেই মামলায় গাড়িচালক মিজানুর রহমানকে ঘটনার দিনই গ্রেফতার করে পুলিশ।

অপরাধীর দল বিচার করার সুযোগ নেই : অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, অপরাধ যেই করুক, তার বিচার হবে। অপরাধীদের দল দেখে বিচার করার কোনো সুযোগ নেই। গতকাল নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, অপরাধীদের কোনো দল বিচার করা হবে না। অপরাধীর বিচার হবে কেবল তার অপরাধের ওপর ভিত্তি করে। এটা আবারও প্রমাণ হলো। তিনি বলেন, ইরফান একজন কাউন্সিলর, একজন সংসদ সদস্যের পুত্র এবং সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্যের জামাতা। তারপরও তাকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হয়নি। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, আরও মামলা হবে। তিনি বলেন, এটা সবার জন্য নজির, অপরাধ করলে শাস্তি হয়, সে যে দলেরই হোক।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর