শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পিলখানায় বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় সেই উদ্দীপক ভাষণ

মেজর নাসির উদ্দিন আহম্মেদ (অব.) পিএইচডি

পিলখানায় বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় সেই উদ্দীপক ভাষণ

স্বাধীনতা-সংগ্রামে ইপিআর সদস্যরা নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

প্রাথমিক প্রতিশোধ, অসহায় ও নির্যাতিত মানুষকে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিতে সহায়তা করা, সেনানিবাস ও পুলিশ ব্যারাক থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে পড়া সৈন্যদের সীমান্তের উভয় পাশে পুনর্গঠিত হতে সাহায্য করা, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত হতে সাহায্য করা সর্বোপরি সেনাবাহিনী, পুলিশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়ে তৎকালীন ইপিআর সদস্যরা এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এই বাহিনীর প্রায় ১২ হাজার সদস্য দীর্ঘ ৯ মাস ধরে সমগ্র রণাঙ্গনের ১১টি সেক্টরে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর সর্বমোট ৮১৭ জন সদস্য শহীদ হন। এদের মধ্যে অপরিসীম বীরত্বের জন্য শহীদ ন্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ এবং শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফকে সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ প্রদান করা হয়। এ ছাড়াও আটজন বীর উত্তম, ৩২ জন বীর বিক্রম এবং ৭৮ জন বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত হয়। টানা নয় মাসের যুদ্ধে শত শত ইপিআর সদস্য আহত ও নিহত হলেও চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত তীব্র যুদ্ধ চালিয়ে যায় ইপিআর সদস্যরা।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয় অর্জনের পর এক ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে এই বাহিনী স্বাধীন দেশের প্রতীক ও অন্যতম উপাদান বা বৈশিষ্ট্য সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমা রক্ষায় অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরত আসেন। দেশে ফেরার ৫৩ দিনের মাথায় অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এই বাহিনীর নতুন নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ রাইফেলস’; সংক্ষেপে বিডিআর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার দুই সপ্তাহেরা মধ্যে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিলিত হন। ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থনীতির স্বার্থে সীমান্ত সুরক্ষা ও চোরাচালান বন্ধের অনুরোধ জানালে বঙ্গবন্ধু তা গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেন। ফলে তিনি সীমান্তে নিয়োজিত সীমান্তরক্ষী তথা বিডিআর সদস্যদের চোরাচালান বন্ধের নির্দেশ দেন। চোরাচালান বন্ধে বঙ্গবন্ধু বিডিআরের পাশাপাশি নবগঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও অন্যান্য আধাসামরিক বাহিনী নিয়োগ করেন। তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানের আমন্ত্রণে বিডিআরে প্রশিক্ষণরত সৈনিকদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে অভিবাদন গ্রহণ করেন। দিনটি ছিল ৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সাল, বৃহস্পতিবার। এদিন সকালে শীতের হালকা কুয়াশায় ভিজে ছিল পিলখানা চত্বর। আর পিলখানার প্যারেড গ্রাউন্ডের পিছনে ছিল পাকা ধান ও হলুদ শর্ষে ফুলের সমারোহ। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় এই পাকা ধান ও শর্ষে ফুলের উজ্জ্বল হলুদ বর্ণ যেন বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিগণিক করার অঙ্গীকারের প্রতীক হয়ে ফুটে ওঠে।

আকর্ষণীয় কুচকাওয়াজ ও শপথ অনুষ্ঠান শেষে জাতির পিতা তার ভাষণ দেন। এই ভাষণ ছিল বিরাজমান পরিস্থিতিতে তার দুঃখ, কষ্ট, অভিমান, অভিযোগ, ক্ষোভ, আশাবাদ, সোহাগ, শাসন এবং কঠোর হুঁশিয়ারির এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ। বক্তব্যের শুরুতে তিনি তৎকালীন বিডিআর সদস্যদের শত বছরের ঐতিহ্য বিশেষত, স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বাস্তব পরিস্থিতিও তুলে ধরেন তাদের সামনে। এরপরই আসে দেশের সীমান্তরক্ষায় বিডিআর বাহিনীর কাছে তার প্রত্যাশার কথা। বঙ্গবন্ধু বলেন চোরাচালানির খবরে তার লজ্জায় মাথানত হয়ে যায়। কারণ জীবন আত্মাহুতি দিয়ে দেশ স্বাধীন করা এই বাহিনীর কেন চোরাচালানি বন্ধ করতে পারবে না, এই প্রশ্ন রাখেন সবার সামনে। বঙ্গবন্ধু মনে করেন চোরাচালানি বন্ধ করতে বিডিআরই যথেষ্ট, অন্য কোনো বাহিনীর প্রয়োজন নেই। দেশের সম্পদ যারা বিদেশে পাচার করে, তাদের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ঘৃণা উচ্চারণ করে বলেন, ‘স্মাগলারের কোনো জাত’ নেই। স্মাগলারের কোনো ধর্ম নেই, তারা মানুষ নামের নরপশু। চোরাচালানের মাধ্যমে অস্ত্রের অবৈধ প্রবেশ এবং এ থেকে সৃষ্ট অনাচারের কথাও ফুটে ওঠে তার ভাষণে। তার মতে, ‘আজ গোপনে, অন্ধকারে মানুষকে হত্যা কওে, হাটবাজার লুট করে। কিছু কিছু অস্ত্র জোগাড় করে মানুষের শান্তি নষ্ট করে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। দরকার যদি হয়, যত ফোর্স আমার আছে, জনগণের সাহায্য ও সহানুভূতি নিয়ে, বাংলাকে বাংলাদেশে একটা চরম আঘাত করতে হবে। এই দুর্নীতিবাজ এই সন্ত্রাসবাদী, এই চোরাকারবারী, এই ঘুষখোরদের দমন করার জন্য। ...

‘চোরা নাহি শুনে ধর্মের কাহিনি তারা আমরি দুঃখী মানুষকে লুট করে খাচ্ছে। তারা (মানুষকে) ২ টাকার মাল ১০ টাকায় বিক্রি করে (তারা) মানুষকে ঠকায় (ঠকিয়ে) খাচ্ছে। তারা মানুষকে ঘরের মধ্যে আজ অন্ধকারে গুলি করে হত্যা করছে। দেশের মাল বিদেশে চালান দিচ্ছে... তোমাদের কাছে শুধু একটা কথাই বলে যাব, দুর্নীতি সমাজবিরোধী দুষ্কৃতকারী, সন্ত্রাসবাদী, চোরাচালানি, এদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে।’ ৪৬ বছর পর আজ পিছন ফিরে বলতেই হয় জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলার পথেই হাঁটছে এদেশ।

বি. দ্র. বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) বর্তমানে বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নামে পরিচিত। লেখক : কলামিস্ট, গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর