বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ইউএস-বাংলার বারবার সোনা চোরাচালান আড়ালের হোতা কারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

থামানো যাচ্ছে না সোনা চোরাচালান। অতীতে অন্য সব এয়ারলাইনসের নাম আসলেও কয়েক বছর ধরে ঘুরে ফিরেই আসছে ‘ইউএস বাংলা’র নাম। কেবল যাত্রী নয়, সোনার বারসহ ধরা পড়ছে এই এয়ারলাইনসে কর্মরত এয়ার হোস্টেজ, কাস্টমার সার্ভিস অফিসার এমনকি ক্যাটারিং সার্ভিসের কর্মীরা। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিচ্ছেন। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, আড়ালেই থেকে যাচ্ছে চোরাচালানে জড়িত গডফাদাররা। এ নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন অনেক অপরাধ বিশেষজ্ঞ। তারা বলছেন, কর্তৃপক্ষের উচিত হবে এসব মামলার তদন্তে গভীরে গিয়ে মূল গডফাদারদের শনাক্ত করা। এর পর তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। নইলে, এভিয়েশন সেক্টরে দেশকেই এর জন্য মূল্য দিতে হবে। দেশের স্বার্থেই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক  চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া ঠিক নয়।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট থেকে ৭ কেজি সোনা উদ্ধার করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। এ সময় সন্দেহভাজন হিসেবে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের ক্যাটারিং সার্ভিসের আট কর্মীকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে রাজস্ব কর্মকর্তা রেশমা খাতুন বাদী হয়ে মামলা দায়েরের পর গতকালই আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের নির্দেশে চার দিনের রিমান্ডে নেয় বিমানবন্দর থানা পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক কবির হোসেন গ্রেফতারকৃতদের প্রত্যেকের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, কলসে যদি ফুটো থাকে তাহলে পানি তো পড়বেই। বিমানবন্দরে কিংবা এয়ারলাইনসগুলোর কোথায় কোথায় সমস্যা আছে এগুলো তো সবাই কমবেশি জানে। কই পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতে তো এমন ঘটনা খুব একটা ঘটছে না। ঘটছে না কেন? কর্তৃপক্ষ শক্ত না হলে এগুলো ঘটতেই থাকবে। তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত চোরাচালানের ঘটনায় অনেক মামলা হয়েছে। আসামি গ্রেফতারও হয়েছে। চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো চার্জশিটেই ঘটনার আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে বলে অন্তত আমার নজরে আসেনি। তবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের এসব বিষয়ে আরও কঠোর হওয়ার সময় এসেছে। আরেকজন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ নূরুল হক বলেন, যতদূর জানি  সোনার মাধ্যমে পেমেন্ট করা হয়। তা হতে পারে অস্ত্র কিংবা মাদক। তবে এসব কর্মকান্ড বন্ধ করার জন্য পেছনের ইন্টারেস্টেড পার্টিকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

গত মঙ্গলবারের মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার সকাল ৭টায় ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের দুবাই থেকে আসা বিএস৩৪২ ফ্লাইট বিমানবন্দরের ৪ নম্বর বোডিং ব্রিজে অবতরণ করে। ওই বিমানের উচ্ছিষ্ট খাবারের বক্স ক্যাটারিং সার্ভিসের গাড়িতে তোলা হয়। এ সময় গাড়ি তল্লাশি করে সোনাগুলো পাওয়া যায়। আটক ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের ক্যাটারিং সার্ভিসের আট কর্মী হলেন- ক্যাটারিং সহকারী মো. আলী রেজা, সাদ্দাম হোসেন, রাশেদুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, আবু সালেহ, হানিফ দেওয়ান, জাহেদুর রহমান ও ক্যাটারিং হেলপার আশরাফুল আলম। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজন ক্যাটারিং সহকারী এবং একজন ক্যাটারিং হেলপার রয়েছে। হাই লিফট কভার্ড ভ্যানের ফুড স্টোরেজ গাড়িতে বিশেষভাবে সোনাগুলো লুকানো ছিল। আটকরা সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে ধারণা করছে কাস্টমস গোয়েন্দারা। কাস্টমস গোয়েন্দারা বলছেন, দুবাই থেকে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইটটি ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে আসে। পরে ওই বিমান থেকে যাত্রীদের উচ্ছিষ্ট খাবারের বক্স ক্যাটারিং সার্ভিসের গাড়িতে তোলার পর তল্লাশি চালানো হয়। একপর্যায়ে ওই বক্সে সাত কেজি ওজনের ৬০ পিস সোনার বার পাওয়া যায়। যার আনুমানিক মূল্য ৪ কোটি ৮৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের ক্যাটারিং সার্ভিসের আট কর্মীকে আটক করা হয়েছে।

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. ইফতেখার আলম ভুঁইয়া জানান, এ ঘটনায় ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের ক্যাটারিং সার্ভিসের আট কর্মীকে আটকের পাশাপাশি সেই গাড়িটি জব্দ করে বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।

এর আগে, গত ২২ জানুয়ারি মাসকাট থেকে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে আসা সারোয়ার উদ্দিন নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে সাত কেজি ২৯০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করেছে ঢাকা কাস্টমস হাউস। কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চোরাচালান প্রতিরোধে কাস্টমস হাউস ঢাকার প্রিভেন্টিভ টিম বিমানবন্দরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে নজরদারি করতে থাকে। পরে মাসকাট থেকে ইউএস বাংলার ফ্লাইটে আসা ওই যাত্রীর কাছে থাকা কালো রঙের ছোট একটি ব্যাগে ৭ কেজি ২৯০ গ্রাম ওজনের ৬২টি সোনার বার এবং ৯৮ গ্রাম স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া যায়। এর আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। বিমানবন্দর থানায় মামলা হলেও বর্তমানে এর তদন্ত করছেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের পরিদর্শক মোরশেদ। তবে গ্রেফতারের পরপরই সারোয়ার উদ্দীন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বলেছেন, ৫০০ ডলারের বিনিময়ে মাসকট এয়ারপোর্ট থেকে তিনি এই প্যাকেটটি নিয়ে এসেছিলেন। তার জবানবন্দিতে নেপথ্যের কারও নামই আসেনি। কাস্টমস সূত্র জানান, ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ২ কোটি ৩২ লাখ টাকার ৪ কেজি ৬৪০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। সোনার বারগুলো কালো স্কচটেপ মোড়ানো অবস্থায় ছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চোরাচালান প্রতিরোধে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট নম্বর বিএস৩১৬-এর যাত্রী অবতরণের সিঁড়ির নিচে ৪০টি সোনার বার পাওয়া যায়। একই বছরের ৩১ জুলাই একই বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার যাত্রী বহনকারী গাড়ির চালকের কাছ থেকে ৩ কেজি ৭১২ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে কাস্টমস, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা।

২০১৯ সালের ২২ নভেম্বর শাহজালালে তিনটি সোনার বারসহ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের কাস্টমার সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট ওমর ফারুককে আটক করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। বিদেশ থেকে সোনার বারগুলো নিয়ে আসা মামুন মিয়া নামে এক যাত্রীকেও আটক করা হয়। এর আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ১৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কাস্টমস হাউসের প্রিভেনটিভ টিম বিমানবন্দরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে ট্রানজিট ও বোর্ডিং এলাকায় নজরদারি এবং তল্লাশি করে। আটক যাত্রী ও ইউএস-বাংলার কর্মীকে পুলিশে দেওয়া হয়। একই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১০ কেজি সোনার বারসহ গ্রেফতার ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু রোকেয়া শেখ মৌসুমী। পুলিশ দুই দিনের রিমান্ড শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে। এ সময় তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন বিচারক তোফাজ্জল হোসেন।

এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর সকালে এপিবিএন সদস্যরা মৌসুমীকে প্রায় ১০ কেজি সোনাসহ গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় এপিবিএনের এসআই হেলাল উদ্দিন বাদী হয়ে মৌসুমীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় সোনা চোরাচালান আইনে মামলা করেন। মামলায় ইউএস-বাংলা থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে যোগ দেওয়া কেবিন ক্রু নেছার উদ্দিন, তার স্ত্রী, যাত্রী সুহেল খাঁ, লাকী ও বাপ্পীকে আসামি করা হয়।

২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকা মূল্যের ১৪ কেজি সোনা জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা। ওই দিন বিকালে ব্যাংকক থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে আসা ফ্লাইটের টয়লেটে ওই সোনা পাওয়ার কথা জানায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। তারা জানায়, প্রতিটি ১০ তোলা ওজনের মোট ১২০টি সোনার বার উদ্ধার হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা দল গোপন সংবাদ পায়, ব্যাংকক থেকে আসা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের (বিএস ২১৪) ফ্লাইটের মাধ্যমে সোনা চোরাচালান হবে। উড়োজাহাজটি অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে তল্লাশি করা হয়। একপর্যায়ে বিমানের টয়লেটে পরিত্যক্ত অবস্থায় ওই বারগুলো পাওয়া যায়।

২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট থেকে ৪ কেজি ৬৪ গ্রাম সমান সোনার বার উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। এয়ারলাইনসের (ফ্লাইট নম্বর বিএস৩২২) ১১ এ ও ১১ বি সিটের ভিতর থেকে ওই সোনা উদ্ধার করা হয়। এর বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তখন জানায় ঢাকা কাস্টমস হাউস। একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট থেকে ৪ কেজি ৬৬৫ গ্রাম সমান সোনার বার উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা। এয়ারলাইনসের (ফ্লাইট নম্বর বিএস২০২) থেকে ওই সোনা উদ্ধার করা হয়। এর বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, বিমানবন্দরে কর্মরত পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিট গত বছরের চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের জড়িত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে গোপনীয় প্রতিবেদন দিয়েছে।

পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সোনা চোরাচালানের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় যথাযথ নিয়ম অনুসারেই তদন্ত করা হয়। সব মামলাই যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।

গত সন্ধ্যায় ইউএস বাংলায় সোনা চোরা চালানের ঘটনা প্রসঙ্গে ফোন দেওয়া হয় ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদকে। বলেন এখন তিনি আর নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করেন না। কাস্টমার সার্ভিস দেখছেন। তিনি এ বিষয়ে জনসংযোগ বিভাগে কথা বলতে বলেন। পরে জনসংযোগ বিভাগের প্রধান কামরুল ইসলামকে কয়েকবার কল করা হয়। তবে প্রতিবারই তিনি লাইন কেটে দেন।

সর্বশেষ খবর