নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) প্রধান মেজর জিয়াউল হকসহ দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা এখনো লাপাত্তা। এরা কোথায় কী অবস্থায় আছে- তা এখনো গোয়েন্দাদের কাছে স্পষ্ট নয়। পলাতক এসব জঙ্গির মধ্যে ৯ শতাধিক সদস্য রয়েছে যারা জামিন নিয়েই আত্মগোপনে গিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের জঙ্গিরা যতক্ষণ পর্যন্ত গ্রেফতার না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঝুঁকি থেকে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পলাতক জঙ্গিদের কেউ দেশেই রয়েছে, আবার কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। অনেকেই দেশের বাইরে বসে ‘গোপন অ্যাপসে’র মাধ্যমে যোগাযোগ করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে।
ব্লগার ড. অভিজিৎ রায় এবং জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার রায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মেজর জিয়াউল হক এবং আকরাম এখনো পলাতক। ২০১৬ সালের ১৯ মে শীর্ষ ছয় জঙ্গিকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। এদের মধ্যে অন্যতম দুর্ধর্ষ জিয়াকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।
২০১১ সালে সেনাবাহিনীতে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার পরই আলোচনায় আসেন মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই জিয়ার আর কোনো সন্ধান মেলেনি। জিয়াকে ধরতে বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করা হলেও আজও তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশে ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তমনা লেখকদের কমপক্ষে নয়জনকে টার্গেট কিলিংয়ের নেপথ্যে ছিলেন এই মেজর জিয়া। আরও কয়েকজনকে হত্যাচেষ্টা পরিকল্পনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। গোয়েন্দাদের ধারণা, আশপাশের দেশের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গেও তার যোগাযোগ রয়েছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গুপ্তহত্যাসহ নানা পরিকল্পনার নেপথ্যে রয়েছেন তিনি। তার তত্ত্বাবধানে এবিটির অন্তত আটটি স্লিপার সেল রয়েছে। প্রতিটি সেলের সদস্য সংখ্যা চার থেকে পাঁচজন। সেই হিসাবে অন্তত ৩০ জন দুর্ধর্ষ ‘স্লিপার কিলার’ জঙ্গি তৈরি করেছেন মেজর জিয়া। তারাই ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তমনা ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যা করে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিস্তারে অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করছে। রাজধানী ও এর আশপাশে টার্গেট কিলিংয়ে জড়িত কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর মেজর জিয়ার নাম জানা যায়। তা ছাড়া এসব জঙ্গির মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড পর্যালোচনা, ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট ঘেঁটেও অনেক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) একাংশের সঙ্গেও মেজর জিয়ার যোগাযোগ রয়েছে।
কমপক্ষে ৯টি হত্যার ‘মাস্টারমাইন্ড’ জিয়া : ২০১৩-২০১৫ সালের মধ্যে পাঁচজন ব্লগার, একজন প্রকাশক ও সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন এমন দুজনকে হত্যা করেছে এবিটি। এই সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হত্যার পেছনেও এবিটি জড়িত। এসব ঘটনার তদন্ত করে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে জিয়ার নাম উঠে এসেছে। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের একটি বাসায় জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় নামে দুজনকে হত্যা করে এবিটির স্লিপার সেলের সদস্যরা। তারা দুজনই সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। এর আগে একই বছরের ৫ এপ্রিল রাজধানীর সূত্রাপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির অদূরে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়, তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, রাজধানীর গোড়ানে ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি ওরফে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই বছরের শেষ দিকে আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে হত্যা করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে। এর আগে ২০১৩ সালে রাজধানীর পল্লবীতে খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার।
নয় শতাধিক জঙ্গি লাপাত্তা : পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, সারা দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত অভিযানে প্রায় ২ হাজার দুর্ধর্ষ জঙ্গি সদস্য গেস্খফতার হয়। এসব সংগঠনের মধ্যে নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), আনসার আল ইসলাম, হিযবুত তাহরীর ও হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি) বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী রয়েছে। যাদের বেশিরভাগ ২০১৬ থেকে ’১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ বিভিন্ন জেলার কারাগার থেকে জামিন নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে। এদের মধ্যে ৯১২ জনের কোনো খবর নেই। জঙ্গি নিয়ে কাজ করা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, জামিনের মাধ্যমে কারাগার থেকে বাইরে বেরিয়েই এসব জঙ্গি সদস্য আড়ালে চলে গেছে। এদের মধ্যে সাতক্ষীরা জেলা থেকে ৭ জঙ্গি, মেহেরপুরে ৩, ঝিনাইদহ থেকে ৬, মাগুরা থেকে ৭, সিলেট জেলা থেকে ২ (হুজি), মৌলভীবাজার থেকে ৩ (জেএমবি), হবিগঞ্জের ১৩, বরিশালের ১৯, বরগুনা জেলার ৩৯, ঝালকাঠির ৩, পটুয়াখালীর ২, পিরোজপুরের ৯, রংপুরে ৯, ঠাকুরগাঁওয়ে ৩০, দিনাজপুরে ১৭, নীলফামারীতে ১৬, কুড়িগ্রামে ৮, পঞ্চগড়ে ২, গাইবান্ধায় ২১ ও লালমনিরহাট জেলার সন্ত্রাসবিরোধী ও বিস্ফোরক আইনের মামলার ৭ জঙ্গি জামিন নিয়েছে। একইভাবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ২৭, ঢাকা জেলার ৩২, নারায়ণগঞ্জের ১৬, টাঙ্গাইলে ২২, গাজীপুরে ২২, ফরিদপুরে ১৪, মাদারীপুরে ১৫, রাজবাড়ীতে ৫, গোপালগঞ্জে ১০, শরীয়তপুরে ২, কিশোরগঞ্জে ১০, নরসিংদীতে ৭, মানিকগঞ্জে ৫, মুন্সীগঞ্জে ১২, ময়মনসিংহে ৫০, নেত্রকোনায় ৬, শেরপুরে ৯, জামালপুরে ৩১, রাজশাহীতে ২০, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩০, জয়পুরহাটে ৩৬, নওগাঁয় ৭, নাটোরে ৮, বগুড়ায় ১৬, পাবনায় ১৬, সিরাজগঞ্জে ৭, সিএমপির ১৪, চট্টগ্রামে ৩১, কক্সবাজারে ৯, কুমিল্লায় ১৪, নোয়াখালীর ২৩, বি-বাড়িয়ায় ২৮, চাঁদপুরে ২৭, লক্ষ্মীপুরে ১৮, ফেনী ১৫, খাগড়াছড়ি ১, রাঙামাটি ১, কেএমপির ২৩, খুলনার ৩, চুয়াডাঙ্গায় ৭, যশোরে ৭, নড়াইলে ২, কুষ্টিয়ায় ১৬, বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন থানায় তালিকাভুক্ত ১৩ জঙ্গি আত্মগোপন করেছে।
 
                         
                                     
                                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        