বুধবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বাংলা ভাষার দূষণ চিহ্নিত করতে প্রতিষ্ঠান দরকার

মারুফ রায়হান

বাংলা ভাষার দূষণ চিহ্নিত করতে প্রতিষ্ঠান দরকার

বাংলা ভাষা চর্চা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। এ কারণে সবাই ভেবেই নিই ভাষাটি আমরা ভালো জানি। কিন্তু একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ বাংলায় লিখতে গেলেই বোঝা যায় তাতে কত ভুল! কথা বলতে গেলেও দেখা যায় ভাষার দূষণ। কেউ বিকৃত উচ্চারণ করছেন, কেউ বাংলার মধ্যে অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহার করছেন। রক্ত দিয়ে ধোয়া আমাদের বর্ণমালা। রক্তের এ ঋণ স্বীকার করতে হলে অবশ্যই ভালো বাংলা জানতে হবে।

ভালো বাংলা জানার অর্থ অন্য ভাষাকে অবজ্ঞা নয়। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য অন্য ভাষাও আমাদের শিখতে হবে। ফরাসি, জার্মান, ইংরেজি ভাষা আমরা আগেই শিখতাম। এখন চীনা, জাপানি, কোরিয়ান ভাষাও শিখতে হবে। এসব দেশের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন বিষয় জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আগে তো মায়ের ভাষা জানতে হবে। এত ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া ভাষাটিকে মন থেকে ভালোবাসেন তার প্রমাণ খুব কম পাওয়া যায়। আজও সর্বত্র বাংলার প্রচলন হয়নি। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীলতা দরকার। সামাজিক আন্দোলন দরকার।

অনেক শিক্ষকও শ্রেণিকক্ষে মিশ্র ভাষায় কথা বলেন। তারাও প্রকৃত শিক্ষক পেয়েছিলেন কিনা প্রশ্ন আছে। যাদের তারা শেখাচ্ছেন তারাও প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে উঠছেন না। বাংলা ভাষার চর্চা এগিয়ে নিতে অভিভাবক দরকার। এ জন্য বাংলা ভাষায় দক্ষ শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক যারা বাংলা ভাষায় কাজ করেন, যারা বাংলা ভাষার জন্য কাজ করেন তাদের নিয়ে একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। ভাষার দূষণ বা বিকৃতি ঘটলেই তারা চিহ্নিত করবেন। সংশোধনে ব্যবস্থা নেবেন। সর্বস্তরে বাংলা চালুর ব্যাপারে অনেক দিন ধরে আলোচনা চললেও আজও তা হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ যারা বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক বিভিন্ন পেশায় যাচ্ছেন, যারা বাংলা নিয়ে কাজ করছেন, আদালতে যারা কাজ করছেন তাদের অন্য ভাষার প্রয়োজন কেন? বাংলায় উচ্চশিক্ষা বইয়ের অভাব হয়তো আছে। কিন্তু মাতৃভাষায় দখল থাকলে ইংরেজি বই পড়ে অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগ তো বাংলায় করা যায়। মূলত আমাদের সদিচ্ছার অভাব। এমন একটা সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে যে বাংলাকে অবজ্ঞা করে অন্য ভাষাকে গুরুত্ব দিলেই সমাজে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে! যেখানে ইংরেজি প্রয়োজন সেখানে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি থাকবে; তবে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন দরকার। কয়েকজন বিচারক বাংলায় রায় লেখা শুরু করেছেন। একে সাধুবাদ জানাতেই হয়। বিচারব্যবস্থার সর্বত্র বাংলার প্রচলন হলে তা হবে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে নতুন প্রজন্মের জন্য এমন কিছু রেখে যেতে পারলে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত।

শুধু মাতৃভাষা চর্চায় গাফিলতি নয়, অন্য ভাষায় দুর্বলতার কারণে বাংলা সাহিত্যকে আমরা বিশ্বদরবারে পৌঁছাতে পারছি না। আমাদেরও বিশ্বমানের সাহিত্য আছে। শুধু ইংরেজিতে সঠিকভাবে অনুবাদ করতে পারলেই বিশ্ববাসীকে দেখাতে সক্ষম হতাম যে আমাদের সাহিত্য কতটা উন্নত। যারা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন, বুকার পুরস্কার পাচ্ছেন তাদের চেয়ে আমাদের অনেক ভালো সাহিত্যকর্ম রয়েছে। তবে এটা প্রমাণ করতে হলে অনুবাদে জোর দিতে হবে। ভালো অনুবাদক খুঁজে বের করতে হবে। এ কাজটাই আমাদের অভিভাবকরা করছেন না।

একুশ শতকে এসে বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি নেহাত কম নয়। বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধির শুরুটা মূলত ভাষা আন্দোলনের পরপরই; ষাটের দশকে। মাঝখানে নানা কারণে হোঁচট খেয়েছি। কলুষিত রাজনীতি, সৈ¦রতন্ত্র সাহিত্যিকদের প্রভাবিত করেছে। বিগত দুই দশকে দারুণভাবে বাংলা সাহিত্যের অগ্রযাত্রা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশিষ্ট লেখকদের অনেকেই মারা গেছেন। সৈয়দ হক, শওকত ওসমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রজন্মকে হারিয়ে ফেলেছি। তাঁদের ভিতরের শক্তি বর্তমান প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে থেকে শনাক্ত করতে পারছি না। পরবর্তীকালে যারা বাংলা সাহিত্যের নেতৃত্ব দেবেন তাদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের কৃপণতা আছে। তার পরও বলব নতুন সময়ের সূচনা হয়েছে। অনলাইনের কারণে সাহিত্যচর্চা বেড়েছে। প্রচুর ই-বুক প্রকাশ হচ্ছে। হতে পারে এর বেশির ভাগই জঞ্জাল। তার পরও বলব নতুন রক্তের সন্ধান পাচ্ছি। এর মধ্যেই অনেকে খুব ভালো লিখছেন। আমি মনে করি বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধির সূচনা হয়ে গেছে, এখন গন্তব্যে পৌঁছার সময়। লেখক : কবি ও সাংবাদিক। অনুলেখক : শামীম আহমেদ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর