সোমবার, ৮ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বিপর্যস্ততা কাটিয়ে টিকায় সাফল্য

করোনা মহামারীর এক বছর

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিপর্যস্ততা কাটিয়ে টিকায় সাফল্য

দেশে করোনা মহামারীর এক বছরে বিপর্যস্ততা কাটিয়ে টিকায় সাফল্য খুঁজছে দেশ। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। করোনার সংক্রমণে বেহাল চিকিৎসা সেবা, ভুয়া টেস্ট বাণিজ্য, দুর্নীতি, রদবদল, মেয়াদোত্তীর্ণ হাসপাতাল-ক্লিনিক ঘিরে বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছিল স্বাস্থ্য খাত। বছরজুড়ে লড়াই শেষে নতুন বছরে টিকায় মহামারী ঠেকানো প্রত্যাশায় দেশ।

করোনা মানুষকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। করোনায় মারা যাওয়া প্রিয়জনকে শেষবার ছুঁয়ে দেখতে পারেননি সন্তানেরা। আবার অনেকে করোনা আক্রান্ত হওয়ায় ফেলে রেখে গেছেন পরিবারের মানুষকে। এই মহামারীতেও কেউ কেউ এগিয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। কাঁধে তুলে নিয়েছেন করোনায় মৃত অপরিচিত ব্যক্তির লাশ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে, করোনার সংক্রমণে দেশে গতকাল পর্যন্ত

মারা গেছেন ৮ হাজার ৪৬২ জন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৫ লাখ ৫০ হাজার ৩৩০ জন। সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৫ লাখ ৩ হাজার ৩ জন। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে প্রথম করোনাভাইরাস ছড়ায়। এরপর চীনের গন্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এই সংক্রামক ভাইরাস। হু হু করে বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। মার্চের মধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়। দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। নারায়ণগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলায় সর্বপ্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ১৪ মার্চ রাজধানী ঢাকায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ঢাকার পর ১৭ মার্চ গাজীপুরে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সংক্রমণ ঠেকাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপরে লকডাউন করা হয় দেশজুড়ে। বন্ধ থাকে সরকারি অফিস-আদালত, যান চলাচল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, হাট-বাজার, আমদানি-রপ্তানি, পর্যটন স্পটসহ সবকিছু। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অফিস বন্ধ রেখে বাসা থেকে কর্মীদের কাজ করার ব্যবস্থা করে। শুরুর দিকে করোনার সংক্রমণ কমের দিকে থাকলেও মে মাসের মাঝামাঝি থেকে করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকে। ওই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই রোগী শনাক্তের হার চলে যায় ২০ শতাংশের ওপরে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেসরকারি হাসপাতালকে করোনা টেস্টের অনুমোদন দেওয়া হয়। করোনা নমুনা সংগ্রহ ও টেস্ট চলতে থাকে বেসরকারি বেশ কিছু হাসপাতালে। কিন্তু রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সবরকম উপসর্গ থাকলেও রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়। রোগী মৃত্যুর পর দেখা যায় তিনি করোনা আক্রান্ত ছিলেন, ভুল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল। এই চক্রকে খুঁজতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে জেকেজি কেলেঙ্কারি। জানা যায়, জেকেজির সাবরিনা-আরিফ দম্পতি কয়েকজন কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে সরবরাহ করতেন। নমুনা সংগ্রহ করে তা ড্রেনে ফেলে দিয়ে মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে সরবরাহ করা হতো। একইভাবে খোঁজ মিলে ভুয়া টেস্টের আরেক হোতা রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদের। ভুয়া টেস্ট রিপোর্টের পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে চুক্তি করেছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গেও। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিবের উপস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদের মধ্যে করোনা আক্রান্তদের ভর্তির চুক্তি সম্পন্ন হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে টেস্ট ও চিকিৎসায় বেশ কিছু দামি যন্ত্রপাতিও সরবরাহ করা হয়। চুক্তির মাস দুয়েক পরেই বেরিয়ে আসে সাহেদের অপকর্মের চিত্র। ২০১৪ সালে মেয়াদ পার হয়ে গেলেও রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করেছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। পালিয়ে যাওয়ার সময় বোরকা পরিহিত অবস্থায় সাতক্ষীরা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন সাহেদ। জেকেজির সাবরিনা, আরিফ ও তাদের অন্যান্য সহকর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিচার চলমান রয়েছে। এরপরেই বেরিয়ে আসতে থাকে পিপিই, মাস্ক কেনা নিয়ে অর্থের নয়ছয়। দেশজুড়ে সমালোচনার মধ্যে পদত্যাগ করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বদলি করা হয়। এরপর স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালকসহ বেশ কিছু পদে রদবদল করা হয়। বদলির হিড়িক পড়ে যায় স্বাস্থ্য অধিদফতর জুড়ে। বেরিয়ে আসে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়ি চালক আবদুল মালেকের শতকোটি টাকার দুর্নীতির চিত্র। বদলির হাওয়া লেগেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরেও। একদিকে দুর্নীতি অন্যদিকে সেবা নিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন করোনা আক্রান্ত রোগীরা। আইসিইউয়ের চরম সংকট ছিল রাজধানীসহ সারা দেশে। আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহের পর থেকে শনাক্তের হার কমতে থাকে। হাসপাতালের এই বিশৃঙ্খলায় বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। হাসপাতালের সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ শয্যায় ভর্তি রোগীর সংখ্যাও কমতে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসে গিয়ে দেখা যায় হাসপাতালের করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৮০ শতাংশ শয্যাই ফাঁকা। আক্রান্তদের ৯০ ভাগেরও বেশি বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অক্টোবর মাসজুড়ে শনাক্তের হার ছিল ১০-১২ শতাংশের মধ্যে। ২ নভেম্বর থেকে ফের বাড়তে শুরু করে করোনার সংক্রমণ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে কি না তা নিয়ে চলে তর্ক বিতর্ক। তবে ২০ দিন পর থেকেই আবার কমতে থাকে সংক্রমণ হার। সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মানায় বারবার জোর দিয়েছেন চিকিৎসকরা। বারবার হাত ধোয়া, মাস্ক পরা ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখায় জোর দেওয়া হয়। কিন্তু বছর জুড়েই উপেক্ষিত ছিল স্বাস্থ্যবিধি। করোনা নির্মূলে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে টিকা আবিষ্কারে। দেশে দ্রুত টিকা আনতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পেতে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড ও সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে। গত ২৫ জানুয়ারি সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম চালানের ৫০ লাখ ডোজ দেশে আসে। এরপরে এসেছে দ্বিতীয় চালানের ২০ লাখ ডোজ টিকাও। এ ছাড়া বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে দিয়েছে ২০ লাখ ডোজ টিকা। গত ২৬ জানুয়ারি রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়ে টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন করা হয়। ভার্চুয়ালি সংযুক্ত থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। এরপর ২৭ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকা দেওয়া হয়। পর্যবেক্ষণ শেষে ৭ ফেব্রুয়ারি দেশে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। এ পর্যন্ত দেশে টিকা নিয়েছেন ৩৭ লাখ ৮৯ হাজার ৩৫২ জন। গতকাল টিকা নিয়েছেন ১ লাখ ৭ হাজার ২০০ জন। সুশৃঙ্খলভাবে দেশব্যাপী চলছে টিকাদান।

 

এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুুল্লাহ বলেন, করোনা মহামারীর শুরুর দিকে ভয়, আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। অর্থনীতি, স্বাস্থ্য খাত, জনজীবন পড়েছিল হুমকির মুখে। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি সামলে আমরা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। দেশে সফলভাবে চলছে টিকাদান। কিন্তু সুস্থ থাকতে এবং দেশকে সুস্থ রাখতে আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

সর্বশেষ খবর