সোমবার, ২২ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ভালো নেই নগরবাসী

খোঁড়াখুঁড়ির শেষ নেই, নিয়ন্ত্রণহীন পরিবহন ভাড়া, লাগামহীন দ্রব্যমূল্য মশার আক্রমণ, বায়ুদূষণ, যানজট, যত্রতত্র আবর্জনা

গোলাম রাব্বানী ও শামীম আহমেদ

ভালো নেই নগরবাসী

বছরজুড়েই চলে খোঁড়াখুঁড়ি

রমজানের আগেই বাড়তে শুরু করেছে দ্রব্যমূল্য। রমজান এলে দ্রব্যমূল্যের অবস্থা কী হবে- তা নিয়ে এখনই শঙ্কিত নগরবাসী। আয় না বাড়লেও বাড়ছে পরিবহন ভাড়া। সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় বেপরোয়া মশার আক্রমণ। সীমাহীন বায়ুদূষণে বিষাক্ত ঢাকার বাতাস; স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নগরবাসী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুললেও লেগেই আছে যানজট। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই নগরীতে। ধুলা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছাড়াই চলছে নির্মাণকাজ। দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে ভাঙাচোরা রাজধানীর অলিগলি। বছরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়িতে অতিষ্ঠ নগরবাসী। নগরবিদরা বলছেন, সমন্বয়হীনতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে নগরবাসীর ভোগান্তি দিন দিন বাড়ছে।

রমজানের আগেই বাড়ছে দ্রব্যমূল্য : কয়েক মাস ধরেই অস্থির চালের বাজার। প্রতি কেজি নাজিরশাইল/মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে এখন ৬০-৬৫ টাকায়। রমজানের আগেই সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে ডাল, খেজুর, তেলসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য। বাড়ছে রমজানের অন্যতম

ভোগ্যপণ্য ভোজ্য তেল, ডাল, আলু ও পিঁয়াজের দাম। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক মাস আগেও খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল লিটারপ্রতি ১১৮ টাকা থেকে ১২০ টাকা। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়। মিরপুরের এক ব্যবসায়ী জানান, শনিবার যে খোলা তেল কিনেছি তার দাম পড়েছে ১৩১ টাকার বেশি। বিক্রি করতে হবে ১৩৫ টাকায়। তবে বোতলজাত তেলের দাম বাড়েনি। এ ছাড়া পাইকারি বাজারে ডালের দাম না বাড়লেও খুচরা বাজারে ডালের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে এক কেজি ভালো মানের দেশি পিঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ৩৫-৪০ টাকায়। এক মাস আগে এই পিঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৫-৩০ টাকায়। আমদানি করা পিঁয়াজের দাম এক মাসের ব্যবধানে ১২-১৫ টাকা বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ডাল, ছোলা ও ভোজ্য তেলের দাম বাড়ছে। এ ছাড়া দরজায় কড়া নাড়ছে রমজান। আর কয়েক দিন পরেই শুরু হবে রমজানকেন্দ্রিক নিত্যপণ্য কেনাকাটার ধুম। ইতিমধ্যেই সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বাড়তে শুরু করেছে রমজানের অন্যতম ফল খেজুরের দাম। কমলা, মাল্টাসহ সব ধরনের ফলের দাম আকাশছোঁয়া। টিসিবির মূল্য তালিকায়ও নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তথ্য মিলেছে।

ভয়াবহ দূষণের কবলে ঢাকা : গত ডিসেম্বর থেকে ঘুরেফিরে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠে আসছে ঢাকার নাম। বিশ্ব বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতকাল রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময়ও ঢাকা ছিল বিশ্বের শীর্ষ দূষিত নগরী। একিউআই (বায়ু মান সূচক) স্কোর ছিল ১৮৮ যা অস¦াস্থ্যকর। ১৭৩ স্কোর নিয়ে ভারতের মুম্বাই ছিল দ্বিতীয়। গতকাল সকাল ৮টায় ঢাকার একিউআই স্কোর ছিল ৪৭২, যাকে বিপজ্জনক বলে অভিহিত করেছে এয়ার ভিজ্যুয়াল। এ ছাড়া ভাঙাচোরা সড়ক, ধুলা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছাড়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি নির্মাণকাজের কারণে পুরো ধুলোর শহরে পরিণত হয়েছে ঢাকা। খিলক্ষেতের বাসিন্দা হিমেল বলেন, বাসা থেকে ধোয়া পোশাক পরে অফিস পর্যন্ত যেতে যেতে ময়লা হয়ে যায়। কিছু দিন ধরে শার্টের ওপরে আরেকটা পাতলা শার্ট গায়ে দিয়ে বের হচ্ছেন। এ নিয়ে নগর বিশ্লেষক ও স্থপতি মোবাশ্বেও হোসেন বলেন, সব কিছুর জন্য দরকার সদিচ্ছা। বর্ষাকালের তুলনায় শীতকালে ৮০ ভাগ বায়ুদূষণ বেড়ে যায়। সিটি করপোরেশন প্রতিদিন রাজধানীর গাছপালাগুলোয় বৃষ্টির মতো পানি ছিটালে ৬০ ভাগ বায়ুদূষণ কমে যাবে। এতে ধুলাবালি কমবে, গাছগুলো বেশি বেশি অক্সিজেন ছাড়বে ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করবে। ফায়ার ব্রিগেড ও পুলিশের জলকামানগুলো বসে থাকে। সেগুলোকেও কাজে লাগানো যায়। এ ছাড়া যেসব যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া বের হবে সেগুলোকে জরিমানা করতে হবে। আমাদের হাতে যন্ত্র আছে, লোকবল আছে। কিন্তু সদিচ্ছা নেই। এ ছাড়া নির্মাণকাজ অবশ্যই ধুলা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে করতে হবে। দূষণ রোধে আইন আছে, শুধু প্রয়োগ দরকার।

মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ জীবন : কয়েক মাস ধরে মশার কারণে সবচেয়ে বেশি বিতর্কের মুখে রয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। অভিযান চললেও কমছে না মশা। সন্ধ্যার পর ঘরে-বাইরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশারের নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিগত ১০ মাসের মধ্যে গত জানুয়ারির শেষ দিকে ঢাকায় মশার ঘনত্ব চারগুণ বেড়েছে। মশা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বইছে সমালোচনার ঝড়। অনেকেই মশা মেরে তা জমিয়ে ‘আজকের সংগ্রহ’ লিখে পোস্ট করছেন ফেসবুকে। মিরপুর পল্লবী আবাসিক এলাকার বাসিন্দা নাসরিন আক্তার বলেন, সন্ধ্যা হলে কয়েল, ধুপ জ্বালাই। তবু মশার যন্ত্রণা থেকে নিস্তার নেই। সিটি করপোরেশন কর্মীদের মাঝেমধ্যে ফগিং করতে দেখি, মশা তো কমে না। কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শীতের শেষদিকে নালা-নর্দমায় প্রবাহমান পানি কমলে সেই পচা পানিতে কিউলেক্স মশা ডিম পাড়ে। আর বর্ষার পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। এটা মাথায় রেখে সারা বছর বহুমুখী মশক নিধন অভিযান চালানো দরকার। এ ছাড়া পাঁচ বছর পর পর ওষুধ বদলানো দরকার।

আবারও বাড়ছে ভাড়া : করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে বাড়ছে না মানুষের আয়। উল্টো অনেকেরই আয় কমেছে। এর মধ্যেই ঢাকা শহরে বাসের নতুন রুটে প্রতি কিলোমিটারে ৫০ পয়সা ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব গেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে। সম্প্রতি বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির এক সভা শেষে এ তথ্য জানানো হয়। জানা গেছে, ঢাকা শহরে বাস ভাড়া কিলোমিটারে এখন ১ টাকা ৭০ পয়সা। নতুন রুটে সেটা ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ২ টাকা ২০ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে সাজা বাড়িয়ে নতুন সড়ক পরিবহন আইন করলেও শৃঙ্খলা ফেরেনি রাজধানীর গণপরিবহনে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সব লেন আটকে বাসের যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় যানজট লেগেই থাকছে সড়কে। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে এবার বাস রুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে দুই সিটির মেয়র সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠকও করেছেন। তবে সে সুফল পেতে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা এখনো অনিশ্চিত।

ভাঙাচোরা সড়ক, যানজটে ভোগান্তি : মিরপুরে রাস্তায় ভোগান্তির শেষ নেই। হাঁটার গতিতে চলে বাস। কোথাও কোথাও হাঁটার গতির কাছেও যেন হার মানে। চওড়া সড়কের প্রায় অর্ধেকটাই খানাখন্দে ভরা। সরেজমিন দেখা যায়, আগারগাঁও থেকে মিরপুর ১২, ১১, ১০ নম্বর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া ও তালতলায় সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে ছোট-বড় অসংখ্য গাড়ি যানজটে অপেক্ষমাণ। গাড়িগুলোতে প্রচ- গরমে বসে থাকতে দেখা যায় নানা শ্রেণি-পেশার যাত্রীদের। রাজধানীর এয়ারপোর্ট থেকে আবদুল্লাহপুর সড়কটি গত কয়েক বছরে একাধিকবার সংস্কার করতে দেখা গেলেও পুরো সড়কটি উঁচু-নিচু। মাঝেমধ্যেই গর্ত। কোথাও উঠে গেছে সুড়কি। আবার কোথাও উঁচু হয়ে আছে জমাটবদ্ধ কংক্রিট। ব্যস্ততম এই সড়কের অধিকাংশ ম্যানহোলের ঢাকনা সড়ক থেকে ২-৩ ইঞ্চি উঁচু বা নিচু, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া কিছু অভিজাত এলাকা বাদে অধিকাংশ ওয়ার্ডের শাখা সড়ক ও অলি-গলির সংস্কার নেই দীর্ঘদিন। ভাটারা এলাকার নতুনবাজার থেকে ছোলমাইদ পর্যন্ত বেহাল সড়কটি গত ৭-৮ বছরের মধ্যে সংস্কার হয়নি বলে জানান স্থানীয়রা। খিলক্ষেতের বরুরা এলাকায় ভাঙাচোরা সড়ক দিয়ে যান চলাচলই দুষ্কর।

খোঁড়াখুঁড়ি চলছেই : ঢাকার ৫৬ সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে একই রাস্তা বারবার খুঁড়ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কখনো পানির লাইন, কখনো বিদ্যুতের ক্যাবল, কখনো ফাইবার অপটিক ক্যাবল, কখনো গ্যাসের পাইপ বসাতে খোঁড়া হচ্ছে। এতে একদিকে জনভোগান্তি লেগেই থাকছে, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হচ্ছে। উন্নয়ন কাজের পরিকল্পনা আগে থেকে জানাতে দুই সিটি করপোরেশন সংস্থাগুলোকে মৌখিক ও লিখিতভাবে বললেও সাড়া দেয়নি অধিকাংশ সংস্থা।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর