শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

ঝুঁকি বাড়ছে হৃদরোগীদের

করোনাকালে ভিড় বেড়েছে হাসপাতালে, মৃত্যুর হারও অনেক, সতর্ক থাকার পরামর্শ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ঝুঁকি বাড়ছে হৃদরোগীদের

করোনাকালে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন হৃদরোগীরা। নিয়মিত চিকিৎসা নিতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। করোনা জীবাণু ফুসফুস ও হার্টে আক্রমণ করলে রক্ত জমাট বাঁধছে অনেক রোগীর। এতে তীব্র শ্বাসকষ্ট ও হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। করোনায় অন্য শারীরিক জটিলতার তুলনায় হৃদরোগীদের মৃত্যুহার বেশি। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডা. আফজালুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হৃদরোগীরা করোনা আক্রান্ত হলে ঝুঁকি বেশি। এ জন্য সতর্ক থাকতে হবে। তবে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ মানুষের শরীরেও হৃদরোগের বিভিন্ন অনুষঙ্গ দেখা দিচ্ছে। করোনা আক্রান্ত হলে শরীরে প্রদাহ হয়। এতে হার্টের পাম্পিং কমে যায়। হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় অনেক রোগীর ফুসফুসে পানি আসছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হার্টের কার্যকারিতা অনেকটা শ্যালো মেশিনের মতো। করোনা রোগীদের নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে। নয় তো অগোচরে শরীরে বাসা বাঁধবে দুরারোগ্য ব্যাধি। করোনা আক্রান্ত হলে মনোবল হারানো যাবে না। শক্ত মনোবল শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম ধরে রাখে।’ দীর্ঘ ছয় বছর ধরে হৃদরোগের সমস্যায় ভুগছেন মিজানুর রহমান। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থেকে একসময় হার্টে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এর পর থেকে ওষুধ সেবন, পরিমিত খাবার এবং ব্যায়াম করে সুস্থ আছেন তিনি। গত বছর দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে বিপাকে পড়েন ৬৪ বছর বয়সী মিজানুর রহমান। সংক্রমণের ভয়ে বন্ধ হয়ে যায় হাঁটাচলা। তাতেও রেহাই মেলেনি করোনার ছোবল থেকে। তিনিসহ পরিবারের তিন সদস্য এবং গৃহকর্মী একসঙ্গে করোনা আক্রান্ত হন। সবার জ্বর, সর্দি, কাশি, নাকে গন্ধ না পাওয়ার সমস্যা হলেও বিপদ বাধে মিজানুর রহমানকে নিয়ে। তার ছেলে সোহানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের খুব বেশি সমস্যা হয়নি। কিন্তু বাবার আগে থেকেই হার্টের সমস্যা থাকায় চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা চলছিল। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন চিকিৎসক। শেখ রাসেল গ্যাসট্রোলিভার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি করা হলে দেখা যায় ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হার্টেরও ক্ষতি করেছে। এরপর রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করলে বাধে বিপত্তি। আইসিইউতে নিতে হয় বাবাকে। করোনা নেগেটিভ হলেও ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এখন বাসায় রেখে চিকিৎসা চলছে।’ জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কাজল কুমার কর্মকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণে প্রাণ হারানোদের মধ্যে হৃদরোগীর মৃত্যুহার বেশি। করোনা আক্রান্ত হলে ফুসফুস বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর হার্টে আক্রমণ করলে অনেকের রক্ত জমাট বাঁধে। এ থেকে অনেক রোগীর হার্ট অ্যাটাক ও কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ঘটনা ঘটে।’ সারা বিশ্বে পরিচালিত অসংক্রামক রোগে আক্রান্তদের করোনায় মৃত্যুর ঝুঁকি শীর্ষক উল্লেখযোগ্য ৪১টি গবেষণাপত্র পুনরায় বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ (মেটা-অ্যানালাইস) করেছেন একদল গবেষক। গবেষক দলে রয়েছেন মোস্তাওরিদ খান, নুরুজ্জামান খান, গোলাম মোস্তাগির, জুয়েল রানা, সাইফুল ইসলাম ও ইকবাল কবির। যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব গ্লোবাল হেলথের প্রকাশিত বিখ্যাত ‘জার্নাল অব গ্লোবাল হেলথ’-এ তাদের বিশ্লেষণাত্মক গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় আক্রান্তের মধ্যে যাদের আগে থেকে কোনো দীর্ঘমেয়াদি বা অসংক্রামক রোগ ছিল তাদের মধ্যেই বেশিসংখ্যক রোগী মৃত্যুবরণ করেছেন। সারা বিশ্বে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগীর মধ্যে যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মৃত্যুঝুঁকি শুধু করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশি। গবেষণাটিতে তারা পেয়েছেন করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে আগে বিদ্যমান কিছু রোগ বা কো-মরবিডিটি যেমন উচ্চ রক্তচাপ (৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ), হৃদরোগ (১১ দশমিক ৯ শতাংশ) ও ডায়াবেটিস (২২ শতাংশ)-এর প্রাদুর্ভাব তুলনামূলক বেশি। শুধু দেশের বাইরে নয়, এ ফলাফল বাংলাদেশি উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগে আক্রান্ত কিংবা এসব রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা বহন করে। আইসিডিডিআরবি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে ২০১৫ সালে প্রায় ২০ শতাংশ পুরুষ ও ৩২ শতাংশ নারী উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ছিলেন। ২০১৮ সালের তথ্য মতে ৪০-৫৯ বয়সী ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ বাংলাদেশির হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা আক্রান্ত হলে যে কোনো রোগীরই ঝুঁকি থাকে। তবে যেসব রোগীর আগে থেকেই শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা আছে তাদের সমস্যা আরও বেশি। হৃদরোগীদের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। অনেক সময় রক্ত জমাট বেঁধে যায়। শুধু হৃদরোগী নয়, করোনায় লিভার ও কিডনি রোগে ভুগছেন এমন ব্যক্তিরাও ঝুঁকিতে রয়েছেন। যারা আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে ভুগছেন তাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর