রবিবার, ৩০ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

কী হচ্ছে টিকটকে

বাড়ছে ধর্ষণ, নারী পাচার সহিংসতা, অশ্লীলতা

জিন্নাতুন নূর

কী হচ্ছে টিকটকে

টিকটক নামক সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরমে আসলে কী হচ্ছে! বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে এই মোবাইল অ্যাপটি এরই মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, এর মাধ্যমে সমাজে পৌঁছে যাচ্ছে ভুল বার্তা। বাড়ছে ধর্ষণ, নারী পাচার ও কিশোর অপরাধ। আশঙ্কাজনক হারে ছড়িয়ে পড়ছে অশ্লীলতা ও সামাজিক সহিংসতা। টিকটকের ফাঁদে পড়ে ঘটছে নারী পাচারের ঘটনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকটকের মতো অ্যাপ সমাজে কিশোর অপরাধের ঘটনা উসকে দিচ্ছে এবং কিশোর-কিশোরীদের নৈতিকতা ধ্বংস করছে। এ ছাড়া এসব অ্যাপের মাধ্যমে উঠতি বয়সীরা ক্রমেই সহিংস হয়ে উঠছে। তারা আরও বলেন, এই অ্যাপ ব্যবহারে কোনো বিধিনিষেধ না থাকার কারণে অ্যাপটির যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। যদি সরকারিভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হতো তাহলে অ্যাপটির এত অপব্যবহার হতো না। বেশ কয়েক দিন পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে, তরুণী ও কিশোরীরা টিকটকের ভিডিওগুলোতে উগ্র সাজে সজ্জিত হয়ে অশ্লীল নাচ-গান ও অভিনয়ের পাশাপাশি নিজেদের মাদক গ্রহণ করার মতো ভিডিও আপলোড করছে। বেশ কিছু ভিডিওতে তরুণ-তরুণীরা লাগাতার সহিংস অভিনয় করে সেগুলো আপলোড করছে। nodi.alvira নামের এক বাংলাদেশি টিকটক অ্যাকাউন্টধারী ক্রমাগত অশ্লীল ভিডিও আপলোড করায় অন্য ব্যবহারকারীরা এখন নদীকে পর্নোস্টার ‘মিয়া খলিফা’ নামে ডাকেন। এমনকি নদী নিজেও এখন এই নামে নিজের পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। Riyaa-t20 নামে আরেক টিকটক অ্যাকাউন্টধারী সোশ্যাল এই মাধ্যমে দিনের পর দিন অন্য ছেলেমেয়েদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করার (অভিনয়) ভিডিও আপলোড করেন। আবার বেশ কিছু টিকটক অ্যাকাউন্ট থেকে কিশোরদের দলগতভাবে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার ভিডিও পোস্ট করে কিশোর অপরাধ উসকে দেওয়া হচ্ছে।

উদ্বেগজনক যে, দেশের এই টিকটক ভিডিওগুলোর বেশির ভাগেই নেই কোনো শিক্ষণীয় বার্তা। উল্টো এসব ভিডিওর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে চলে যাচ্ছে ভুল বার্তা। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এই অ্যাপটির অপব্যবহারের কারণে এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবার বিব্রতকর, অনৈতিক ও অশ্লীল ভিডিও যা পর্নোগ্রাফিকে উৎসাহিত করে তা প্রচার করায় বিভিন্ন দেশ থেকে এর ব্যবহারের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানে এরই মধ্যে নিষিদ্ধ হয়েছে টিকটক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত এই অ্যাপগুলোর মধ্যে এক ধরনের ‘শো অফ’-এর বিষয় থাকে। দেখা যায় টিকটকের কিছু ভিডিওতে বাইক স্টান্ট থাকে। আবার কিছু ভিডিওতে চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের অনুকরণ করা হচ্ছে। মাতৃভাষার বদলে হিন্দি ভাষায় অ্যাকাউন্টধারীরা লিপ সিং করছে। কেউ কেউ অশ্রাব্য ভাষায় অভিনয় করছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাও টিকটক অ্যাপ ব্যবহার করছে। তারা সেখানে গ্রুপ করে অন্য সদস্যদের যুক্ত করছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি কিশোর গ্রুপ আছে, যারা টিকটক গ্রুপ নামেই বেশি পরিচিত। গ্রুপটির নাম ‘ল্যারা দে’। আশঙ্কাজনক যে, গ্রুপটি ক্রমেই সন্ত্রাসী গ্রুপে পরিণত হচ্ছে। তারা টিকটকে বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট পোস্ট করে অন্য কিশোরদেরও এই গ্রুপে সংযুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। সম্প্রতি ভারতে পাচারকৃত এক বাংলাদেশি নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় নির্যাতনকারী হিসেবে দেশের আরেক টিকটক ব্যবহারকারী ‘টিকটক হৃদয়’-কে এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। টিকটকের অপব্যবহার সম্পর্কিত দুটি ঘটনা তুলে ধরা হলো-

ঘটনা-১ : দেওয়ান রসুল হৃদয় (১৯) বিভিন্ন ভিডিও তৈরি করে তা টিকটক ও লাইকি নামক অ্যাপে আপলোড করত। টিকটকে শুটিংয়ের কথা বলে অভিনয়ের ফাঁদে ফেলে একে একে চার ছাত্রীকে নিজের বাসায় আটকে রেখে ধর্ষণ করে বলে হৃদয়ের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে। গত বছর ১৬ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কুড়িলে হৃদয়ের বাসায় এসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ঘটনার শিকার ছাত্রীরা ভাটারা থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ হৃদয়কে গ্রেফতার করে। এই কিশোরীদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। পুলিশের তদন্তে জানা যায়, গ্রেফতার হৃদয় সিরিয়াল রেপিস্ট। সে তার ফেসবুকে ‘টিকটক ও লাইকিতে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে’ এমন বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থীদের ফাঁদে ফেলে এই পাশবিকতা চালায়।

ঘটনা-২ : গত বছরের শেষ দিকে টিকটক করতে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ওই কিশোরীকে তিন দিন একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। গণধর্ষণের পর নির্যাতিতাকে পুলিশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ঢাকার পৃথক দুটি স্থান থেকে দুই কিশোরকে আটক করে পুলিশ। নির্যাতিতা কিশোরী টঙ্গীর একটি বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। সে টিকটক ভিডিও তৈরি করত। দেশের বিভিন্ন জেলায় টিকটক তৈরি করে এমন বন্ধুদের সঙ্গে মেসেঞ্জার গ্রুপে সে যুক্ত ছিল। পরে অন্য বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে টিকটক তৈরির জন্য ঘর থেকে বের হয়ে মেয়েটি নির্যাতনের শিকার হয়। ঘটনার দিন গ্রেফতার দুই কিশোর নির্যাতিতাকে একটি কক্ষে আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, বেশ কিছু মোবাইল অ্যাপ উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের এক ধরনের বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই অ্যাপসগুলো বন্ধ করার জন্য প্রকৃত সংস্থা হচ্ছে বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)।

এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট যারা বিষয়টি মনিটরিং করছে তারা চাইলেও এসব অ্যাপ বন্ধ করা সম্ভব।

তাদের মতে, যেহেতু এসব ভিডিও পোস্ট করার জন্য কেউ সরাসরি ফৌজদারি অপরাধে জড়ায় না, এ জন্য প্রাথমিকভাবে এসব কিশোর-তরুণের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মাহফুজা খানম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীরা তাদের এনার্জি লেখাপড়ার বদলে টিকটকের মতো অ্যাপে খরচ করছে। এর মাধ্যমে তারা বিনোদন ও উত্তেজনা খুঁজে নিচ্ছে। এই বয়সী শিশুদের আকর্ষণ করার মতো উপাদান টিকটকের আছে। এ জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময় শিশু-কিশোররা এখন টিকটকের পেছনে ব্যয় করছে। কিন্তু এসব বিষয়ে সেন্সরশিপের প্রয়োজন আছে। এ ধরনের অ্যাপ ব্যবহারে কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় এর যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। যদি সরকারিভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হতো তাহলে এর এত অবাধ ব্যবহার হতো না। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, টিকটক কিশোর অপরাধের মতো ঘটনা উসকে দিচ্ছে। কিশোরদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তারা যে অপরাধগুলো করে তা একাকী নয়, দলগতভাবে করে থাকে। এ ক্ষেত্রে যেসব কিশোর-কিশোরীর চিন্তাভাবনা একই ধরনের, তারা যখন কোনো নেতিবাচক কাজ করে তা দলগতভাবেই করে। এর ফলে এই কম বয়সীদের মাদক গ্রহণ ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর